শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা কাম্য

প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২শ’ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই তহবিল সুদমুক্ত নয়। যত স্বল্পই হোক, এর বিপরীতে বাংলাদেশকে সুদ গুণতে হবে। এই বিবেচনায় টিআইবি অভিযোগ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণে সহায়তা না দিয়ে বিশ্বব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সুদের ব্যবসা চালানোর কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সুদ যত কমই হোক, এতে ঋণের বোঝা বাড়বে। আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা এমনিতেই যথেষ্ট ক্ষতি ও ঝুঁকির সম্মুখীন। তাদের ঘাড়ে আবার ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে এবং তার মাধ্যমে সুদের ব্যবসা চলবে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তিনি এই সুদের ব্যবসার খপ্পরে না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, আমাদের যে নেতিবাচক ও ঝুঁকি পরিস্থিতি, তার জন্য আমরা ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ পাবো। সে ক্ষতিপূরণটাই যেন আমরা পাই। সরকারকে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বব্যাংক যদি সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কোনো সহায়তা করতে আগ্রহী হয় তাহলে যেন ক্ষতিপূরণের জায়গায় থাকে, ঋণের ব্যবসায় না নামে। একটি প্রস্তাবও তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে বাংলাদেশের অভিগম্যতার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, এই ফান্ডে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে এমন কিছু স্ট্যান্ডার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে বাস্তবায়ন করা কঠিন। যতদিন সেগুলোর বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হবে ততদিন ওই তহবিলের সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে না।
বিশ্বে জলবায়ু পরিস্থিতিজনিত ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে যেসব দেশ রয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলীয় প্লাবনসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অন্যান্য দুর্যোগ ও প্রথাগত জীবনযাত্রা ধ্বংস হওয়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবে। এসময় উপকূলীয় এলাকার একটা বড় অংশ তলিয়ে যাবে। তখন মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী রকম নাজুক ও বিপর্যয়কর হয়ে পড়বে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আশঙ্কিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যথোপযুক্ত প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নেয়া বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এখানে বলে রাখা দরকার, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো মোটেই দায়ী নয়। দায়ী উন্নত দেশগুলো। তাদের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ দেয়া। কথা ছিল উন্নত দেশগুলো এর জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি ডলার প্রদান করবে। কিন্তু গত ৬ বছরে তারা মাত্র ৩৬ হাজার কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে যে সব স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোই ওই ফান্ডের সুবিধা প্রাপ্তি অনিশ্চিত করে দিয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো অসহায় ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ তার আশংকার দিকটি ভালভাবে অবহিত। যে কারণে নিজস্ব উদ্যোগেই সে একটি তহবিল গড়ে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া ও আন্তর্জাতিকভাবে এব্যাপারে সক্রিয় তৎপরতার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে তহবিল গঠন একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অথচ দুঃখের বিষয়, বিগত বাজেটে এই তহবিলের ওপর যথেষ্ট সুবিচার করা হয়নি। জাতীয় স্বার্থেই এ তহবিল টিকিয়ে রাখা এবং স্ফীত করা অপরিহার্য।
সরকারের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। এ জন্য জাতীয়ভিত্তিক স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের বিকল্প নেই। বিকল্প নেই জাতীয়ভিত্তিক ফান্ড বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করা। অন্যদিকে যেহেতু বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিবহুল দেশের একটি হওয়ায় ক্ষতিপূরণ ও আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে অর্থ লাভের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত হকদার, সুতরাং ক্ষতিপূরণ আদায় ও গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে অর্থ লাভের চেষ্টা আরো জোরদারভাবে চালিয়ে যেতে হবে। এখাতে ঋণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের চিন্তা বা উদ্যোগ পরিহার করাই হবে যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঋণনির্ভরতার কথা আমাদের অজানা নেই। ঋণ নিলে সুদ দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে সুদাসলে পরিশোধ করতে হয়। একথাও আমাদের অজানা নেই, সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উদারহস্তে ঋণগ্রহণ করছে। অন্যান্য প্রয়োজনেও ঋণ নিচ্ছে। দেশীয় উৎসগুলো থেকে যেমন তেমনি আন্তর্জাতিক উৎসগুলো থেকেও ঋণ নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উৎসগুলো থেকে উচ্চসুদ ও অন্যায্য শর্তেও ঋণ নেয়া হচ্ছে। ঋণ যেখানে থেকে যেভাবেই নেয়া হোক না কেন, এর বোঝা কিন্তু জনগণের ঘাড়েই চাপছে। এই বাস্তবতায় ঋণের বোঝা আরও বাড়ানো বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক হবে না। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের ঘোষিত ঋণ নেবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত  তাকে গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করেই নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন