সরকারের উন্নয়নকর্মকাণ্ড দেখভালের জন্য সরকারেরই একটি সংস্থা রয়েছে, যার নাম ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি)। অথচ, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লুটপাট-দুর্নীতির ফিরিস্তি বিশাল। প্রকল্পে দুর্নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সেটা এখন লাগামহীন হয়ে পড়েছে। টাকা মারার জন্যই প্রকল্প, অবস্থাটা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্নদাতা সংস্থা তাদের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে বহুবার। বলতে গেলে প্রকল্প আর দুর্নীতি একাট্টা হয়ে গেছে এখন। যেখানে প্রকল্প সেখানেই দুর্নীতি। এই দুর্নীতি ও লুটপাটের বেশির ভাগই করছে সরকারি দলের লোকজন এবং দলবাজ কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় প্রত্যাশিত উন্নয়ন কীভাবে হবে? আইএমইডি সংস্থা তাহলে করছেটা কী? উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না কেন? প্রচার আছে সবাইকে নৈতিকতা শেখানোর এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি আজ নিজেই নাকি অনৈতিকতার পঙ্কিলে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই এখন দুর্নীতি-লুটপাটের মহোৎসব চলছে।
দুর্নীতি পুরোপুরি দমন করা না গেলেও অন্তত নিয়ন্ত্রণে থাকলে দেশোন্নয়নে আলোর ঝলকানি সাদা চোখেই দেখা যেতো। তারপরও বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এই মড়ক-দুর্বিপাকেও গত অর্থবছরের চেয়ে উন্নয়ন ব্যয়ে গতি এসেছে। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা এসেছে আকাক্সক্ষার চেয়েও বেশি। কিন্তু গোলমাল অন্যখানে। কার্যত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও প্রশাসনিক-সামাজিক-পারিপার্শ্বিক নানা মন্দ ঘটনা পিছু টেনে ধরছে।
করোনার ধকলের মধ্যেও চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। তা ৬ দশমিক ৮ শতাংশের বেশিতে ঠেকবে বলে সুসংবাদ দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। তাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে: মহামারি করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটির অর্থনীতি। যে কারণে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি দুটোই আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে। এর উল্টো ফলও আছে। আমদানির উল্লম্ফনে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আর ধারণা বা শঙ্কাকে অমূলক করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান কেবল বাড়েনি, নতুন রেকর্ডও করেছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত নভেম্বরে এক লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন বিদেশগামী কর্মীকে ছাড়পত্র দিয়েছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। বিএমইটির হিসাব বলছে, ২০১৭ সালের মার্চে এক লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। ওই বছর মোট গিয়েছিলেন ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন, যা ছিল দেশের জন্য রেকর্ড। পরের বছর ২০১৮ সালে সাত লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০১৯ সালে সাত লাখ কর্মী বিদেশে যায়। কিন্তু মহামারির কারণে ২০২০ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান থমকে যায়। ওই বছর মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে যায়। এর মাঝেই আবার খুলেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। লিবিয়াসহ কয়েকটি দেশে কর্মী পাঠানোর চেষ্টাও চলছে। এটি সাফল্যের মুখ দেখলে আগামী দিনগুলোতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আলোড়ন তৈরি হবে।
শত ধরনের পণ্য দেশে উৎপাদন হলেও আমদানি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে আমদানি ব্যয় বাড়লে অর্থনীতির জন্য ভালো খবর। আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। আর বিনিয়োগ বাড়া মানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। এর বিপরীতে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আমদানির নামে দেখানো ব্যয় পাচারের উদ্দেশে বিদেশ চলে যাচ্ছে কি না? এ ছাড়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে। এতে এরইমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। আলোর সঙ্গে আঁধারের এই সমান্তরাল যাত্রার মধ্যে সম্ভাবনার মধ্যে শঙ্কাও উঁকি দেয়। করোনার ধাক্কা সামলে শিনা টান করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। আগের চেয়ে বেড়েছে ক্রয় আদেশ। বিশেষ করে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছরের এই সময়ে রফতানি বেড়েছে ১০০ কোটি ডলার। শতাংশের হিসাবে যা ৪১ দশমিক ৬৬।
মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিপর্যস্ত সময়ে বাংলাদেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথ ধারার বিপরীতে আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পেও ইতিবাচক ধারা বাংলাদেশে তারপরও আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম কুড়িয়েছে। কিন্তু, এসব সুনামকে বরবাদ করে দিচ্ছে নানান উপসর্গ-অনুষঙ্গ। যা প্রাসঙ্গিকই নয়, আলোচনায়ই আসার কথা নয়-তাই হয়ে যাচ্ছে বার্নিং ইস্যু। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মানবিকতার চেয়ে বড় খবর হিসেবে সামনে আসছে রোহিঙ্গাদের খুন-খারাবি, চাঁদাবাজির খবর। আরসাসহ নানা গ্রুপ-উপগ্রুপ মোকাবিলার দায় বর্তাচ্ছে সরকারের ওপর। সেখানে ব্যর্থতা বৈ সাফল্যের ভাগ মিলছে না। আলোকে ধেয়ে নিচ্ছে অন্ধকারের দিকে। যেখানে মহামারির মধ্যেও থেমে নেই মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ; সেখানে আলোচনায় চলে আসছে একেকটি প্রকল্পে দুর্নীতি-লুটপাটের চাঞ্চল্যকর খবরের সিরিয়াল।
এছাড়া সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা জিএফআই’র এক রির্পোট বলছে, অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের হার আরও বেড়েছে। গত ৬ বছরে দেশের চার লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (৪৯৬৫ কোটি ডলার) বিদেশে পাচার হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রসঙ্গত ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এর কাজ হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করা। একই সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে।
এরই অংশ হিসাবে প্রতি বছর তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। মূলত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পার্থক্য থেকে এই রিপোর্ট করে জিএফআই। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, যুক্তরাষ্ট্র আবার ওইসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি দেখায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারি তথ্যে দেখা গেল, তারা যুক্তরাষ্ট্রে তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যে দেখা গেল তারা বাংলাদেশ থেকে চার বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মানে হলো বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির তথ্য গোপন করেছে। ওই অর্থ পাচার হিসাবে ধরা হয়। জিএফআই বলছে, বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৮২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার এভাবে বেরিয়ে যায়, যা মোট বাণিজ্যের ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো শিল্প বা প্রতিষ্ঠানই ভালো অবস্থায় নেই। ব্যতিক্রম বাদে সবই চলছে লোকসানে। এ জন্য প্রতিবছর সরকারকে বিপুল অংকের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকার এই অপচয় চলছে বছরকে বছর। অথচ, এই অবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যেন কিছু মানুষের সুবিধা দেওয়ার জন্যই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, পিপিপি ভিত্তিতে ১৩টি টেক্সটাইল ও কটনমিল চালুর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে শেষ পর্যন্ত সেগুলো চালু করা সম্ভব হবে কিনা সেটা অজানা। তাই পিপিপিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা মোটেই আশাপ্রদ নয়। এখানে নানা উপসর্গ ও প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। পিপিপিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান বাধা দুর্নীতি। এছাড়া অস্বাভাবিক ব্যয়, সময় মত প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া, অসম্পূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই, সরকারের নজরদারির অভাব এবং সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় পিপিপিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে। পিপিপি সংক্রান্ত ওই সেমিনারে বক্তরা বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে যত অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রয়োজন সরকারের একার পক্ষে তা করা সম্ভব না হওয়ায় পিপিপিভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে রেল, টেলিকম, বিদ্যুৎসহ নানাখাতে ৪৭টি প্রকল্প। এসব প্রকল্প ঠিকমত যাচাই বাছাই করে, সম্ভাব্যতা নিরীক্ষণ করে নেয়া হয়েছে কিনা সে প্রশ্নের পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে অর্থের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এতে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে, ব্যয়ও বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। এখাত থেকে পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থানের আশা কম। এমতাবস্থায়, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন