নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইপিজেড নিয়ন্ত্রণ, শীতলক্ষা নদীর পাড়ে বালু মহল, টেন্ডারবাজি, সিমেন্ট কারখানার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সেক্টরে একক আধিপত্য বিস্তার করছেন মতিউর রহমান মতি। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক ও নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র। মতির ভয়ে খোদ থানা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দরাও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। মতির রামরাজত্ব চলছে পুরো এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইয়াসমা নিটিং, ইয়েজস্টার ইউকহোমা, এস এম এল, সুপার প্রজেক্ট সুজ, সুপ্রিম নিট ওয়ার, ট্যাক্স জিপার সেয়াদ গামেন্টস, মারুহিশা, ইপিকের চারটি কারখানা, অনন্ত এপ্যারেলস, রেমি হোল্ডিং, নিউ টপ, লিনটাচ, ফলমল গ্রুপের আয়েশা ফ্যাশন, ট্যাক্স জিপার, শিমড়া ফ্যাশনের তিনটি কারখানা, পগ্রেস, ইয়েষ্টার, ইন্টার লেভেল, হিমেলটন, ডিএমবি, চেক পয়েন্ট, ইউকোহামা, সাইভোনিশী, টিএসটেকসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান রয়েছে মতির দখলে। আদমজী ইপিজেটে জুট ব্যবসা, ঠিকাদারি, কারখানার খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন মতিউর রহমান মতি। মাত্র কয়েক বছরের তিনি অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এলাকায় ক্ষমতাধর ও একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত তিনি। আদমজী ইপিজেডের কারখানাগুলোতে প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এসব কারখানার নির্মাণ সামগ্রী, খাবার সরবরাহ, মনোহারীদ্রব্য, শ্রমিক নিয়োগ, নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী সরবরাহ করে বিভিন্ন কারখানার পরিত্যক্ত সামগ্রী জুট ব্যবসাসহ সকল রকম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন মতিউর রহমান মতি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার টেন্ডারবাজি, শীতলক্ষ্যা নদীতে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, মেঘনা আর যমুনা তেলের ডিপো নিয়ন্ত্রণ, আদমজী জুট মিলের ইপিজেড নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পুরো এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছেন মতিউর রহমান মতি। বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতে গড়ে তুলেছেন ২০ থেকে ২৫ জনের ক্যাডার বাহিনী। কিছুদিন পরপরই তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা ব্যবসা বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরেন।
সরেজমিনে বুধবার সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি দখল করে যুবলীগের কার্যালয়, নিজের ব্যক্তিগত অফিস, ২০ থেকে ৩০টি দোকান নির্মাণ করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। সরকারি জমিতে নূরে মদিনা নামে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করে নিজেই প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছেন। পাশেই গড়ে তুলেছেন অটোরিক্সার গ্যারেজ। টিনশেডের তৈরি ওই অটো গ্যারেজে প্রতি রাতে রাখা হয় ৫ শতাধিক অটো, যেখানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ওইসব অটোতে চার্জের ব্যবস্থা করা হয়। মতির নির্দেশে তার ভাগ্নে মামুন, মিন্টু, বাবলা, পানি আক্তারসহ একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। মতিউর রহমান মতি আধিপত্য বিস্তার করতে গড়ে তুলেছেন, এলাকায় একটি ক্যাডার বাহিনী। যারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে নানাভাবে মানুষকে জিম্মি করে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
এসও রোড এলাকায় রেলওয়ের প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করে টিনের বাউন্ডারি করে দখল করে রেখেছেন কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি। জায়াগটির বর্তমান মূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। এই জমিটিকে তিনি ময়লার ভাগাড় বানিয়ে রেখেছেন।
আইলপাড়া এলাকার মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে মতিউর রহমান মতি। তিন ভাইয়ের মধ্যে জজ মিয়ার স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন আতাউর রহমান। তার ছোট ভাই মাহবুবই হচ্ছেন মতিউর রহমান মতির অন্যতম সহযোগী। মতির হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ভাই মাহবুব মিয়া। এ ছাড়া রয়েছে ভাগ্নে মামুন, মানিক মাস্টার ওরফে ক্যাশিয়ার মানিক, মাইগ্যা কাদির, জসিম, মানিক, রাব্বি, মাহবুব, সেন্টু, হাবু, গুজা লিটন, সেলিম, ল্যাংড়া রবিউল, আসলাম, টাল মজিবুর, পানি আক্তারসহ আরও অনেকে। এছাড়াও অস্ত্রধারী ক্যাডারদের মধ্যে রয়েছে আদমজী সোনা মিয়া মার্কেট এলাকার কাদির ওরফে মাইগ্গ্যা কাদির, বাবু, কদমতলীর নয়াপাড়ার একাধিক মামলার আসামি সরল ওরফে ডাকাত সরল, আব্দুর রব মিয়া ও নোয়াব। মতির ওই ক্যাডারদের নামে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাসহ আশপাশের থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
এলাকাবাসীরা জানায়, গেলো পাঁচ বছর ধরে আমদজী নতুন বাজার এলাকার রমজান মহাজনের এক কাঠা জমি দখল করে মতিউর রহমান মতি বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৩০ লক্ষ টাকা। একই এলাকায় মোস্তফা মিয়ার তিন কাঠা জমি দখল করে নিয়েছেন যার আনুমানিক মুল্য ৬০ লক্ষ্য টাকা। আদমজী বাইতুন নূর জামে মসজিদের দক্ষিনে সরকারি জমিতে মার্কেট নির্মাণ কাজ করছেন মতিউর রহমান মতি। চড় সুমিলপাড়া এলাকায় সোনামিয়া বাজার বনিক সমিতির সভাপতি সাইদুল হকের আট শতাংশ জমি দখল করে একটি কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা। এছাড়াও ওই এলাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ জমি জোড় পূর্বক দখল করে একটি কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দেন মতি। শাহাদাতের ছয় শতাংশ জমি দখল করে বিক্রি করে দেন। আদর্শ ক্লাবের সাত শতাংশ জমি অবৈধভাবে গ্যারেজ বানিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ দিয়ে অটোরিক্সার গ্যারেজ বানিয়েছেন। হাকিম আলীর ৫ শতাংশ জমি, লেংড়া হাফিজের ২ শতাংশ জমি মাত্র দুই লক্ষ টাকা দিয়ে জমিটি জোড় পূর্বক নিয়ে নেন মতিউর রহমান মতি। নতুন বাজার এলাকায় ৭৫ শতাংশ জমি দখল করে এ্যাকটিভ স্কুল, আজমেরী রেষ্টুরেন্ট ও মার্কেট করে ৫০টি দোকান নির্মাণ করেছেন, যেখানে হুশিয়ারী, কাপড়, গার্মেন্টস, রেডিমেট গার্মেন্টস, মেডিসিন, মনোহারীসহ বিভিন্ন দোকান ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিচেছন কয়েক কোটি টাকা। সুমিলপাড়া বিহারী ক্যাম্পের মাঝ খানে বড়পুকুর দখল করে মাছেন ব্যবসা করছেন তিনি। আইনপাড়া এলাকায় ৪০ শতাংশ হিন্দু সম্পত্তি দখল করে বিক্রি করে দিয়েছেন। আদমজী নতুন বাজারে ফের রেষ্টুরেন্ট সাইদুল হক, আবুল কালাম মোল্লা, আবুল কালাম আবুকে ফুসলিয়ে রেষ্টুরেন্টটি তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও কদমতলী পুকুরের পশ্চিম পার্শে খ তালিকায় জায়গা প্রায় দুই বিঘা জমি খাড়া দলিল করে বিক্রি করে দিয়েছেন।
রিফিউজের গ্রাম প্রধান মৃত মাকসুদ প্রধানের ছেলে সুলতান আহম্মেদ গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশ সরকার ১৯৬৪ সাল থেকে আমাদের বসবাস করার জন্য সাত একর জমি দিয়েছিলেন। বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি ও লোকজন আমাদেরকে হুমকি ধমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বেশীর ভাগ জমি একটি কোম্পানী ও স্টান্ড ডকইয়ার্ডের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এই জমিতে হাইস্কুল, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিলো। যা সবই কেড়ে নিয়েছেন মতিউর রহমান মতি। তিনি বলেন, আমরা গরীব অসহায় তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাই না। ইতোমধ্যেই কয়েকবার হামলা ও মামলার শিকার হয়েছি একাধিকবার। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভুমিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেও কোন ফল পাইনি।
আদমজী নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, কাউন্সিলর মতি রেলওয়ের জায়গা দখল করে এ্যাকটিক স্কুল, নতুন বাজার নামে একটি মার্কেট করে অর্ধশতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া উত্তোলন করছেন। এই সম্পত্তির মূল্য প্রায় অর্ধশতাধিক কোটি টাকা।
সুমিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু খান জানান, ২০১১ সালে নাসিক নির্বাচনে মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করায় আমার দীর্ঘদিনের ডিস ব্যবসা কেড়ে নিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আমার বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। আমদমজী সোনামিয়া বাজার বনিক সমিতির সভাপতি সাইদুল হক জানান, মতিউর রহমান মতিসহ আমরা চারবন্ধু মিলে আদমজী বাজারে বিফোর রেষ্টুরেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান করেছিলাম। পরে আমাদের সাথে প্রতারণা করে সে এককভাবে রেষ্টুরেন্টটি দখল করে পরিচালনা করছেন।
সরকারি জমি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক মতিউর রহমান মতি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিপক্ষের লোকেরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমি কোন অনিয়ম, দুর্ণীতির সাথে জড়িত নয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া জানান, দলের নাম ব্যবহার করে কেউ যদি কোন দুর্নীতি, দখল, অনিয়ম করে, তাহলে তাদের কোন অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের এসেট কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, রেলের সম্পত্তি দখল করে যারাই মার্কেট নির্মাণ করছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ ব্যবস্থা গ্রহন জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে, এই এলাকায়ও আমরা উচ্ছেদ অভিযান খুব শিগ্রহ পরিচালনা করব।
এ বিষয়ে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক, তানভীর মাহমুদ পাশা গণমাধ্যমকে জানান, দুর্নীতিবাজ যেই হউক না কেন ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, রেলওয়ের জায়গা অবৈধভাবে কেউ দখল করে থাকলে রেলওয়ে কর্মকর্তা চাইলে ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করে ওই সকল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন