উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর চতুর্দশ বার্ষিক ঈসালে সাওয়াব মাহফিল গতকাল শনিবার জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলী ছাহেববাড়ী সংলগ্ন বালাই হাওরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুলতলী অভিমুখী জনতার স্রোত ছিল চোখে পড়ার মতো। আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর মাযার, মাহফিলের প্যান্ডেল, বাজার, রাস্তা-ঘাট সবই ছিল লোকে লোকারণ্য। নেমেছিল লাখ লাখ মানুষের ঢল। সকাল সাড়ে ১০টায় এতীমখানার হাজারো এতীমসহ আগত মেহমানদের নিয়ে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের (র.) মাযার যিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মাহফিলের কার্যক্রম। এরপর অনুষ্ঠিত হয় বেকার দরিদ্রদের মধ্যে রোজগারের উপকরণ বিতরণ, উপস্থিত জনতার মধ্যে ১০ হাজার প্যাকেট কদুর বীজ ও সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে ছাগল, রিকশা, ঠেলাগাড়ী, চৌকি, সেলাই মেশিন, নগদ অর্থ, শিরনীর প্যাকেট ইত্যাদি সাওয়াব রেসানীর উদ্দেশ্যে বিতরণ করা হয়। মাহফিলে উপস্থিতদের নিয়ে অর্ধ শত খতমে কুরআন ও দালাইলুল খাইরাত শরীফের খতম সম্পন্ন করা হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রায় পাঁচ হাজার খতমে কুরআন হয়েছে বলে জানা যায়। বাদ যুহর খতমে খাযেগান ও দু’আ শেষে মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে তা’লীম-তরবিয়ত ও হৃদয়গ্রাহী বয়ান পেশ করেন উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব, ফুলতলী।
সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাদেরকে রোজগার করে জীবন যাপন করার মাধ্যমে আল্লাহর বন্দেগী করতে হবে। একমাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী ছাড়া দুনিয়ার কারো মুখাপেক্ষী হওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজগারের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এক ব্যক্তিকে রোজগারের উপকরণ দিয়ে বললেন, তোমাকে যেন আগামী পনের দিনের মধ্যে না দেখি। তার অর্থ তুমি উপার্জনে নিয়োজিত হয়ে যাও। হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.) দরিদ্র মানুষকে রোজগারের উপকরণ প্রদান করতেন। তার এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আপনারাও মানুষদের মাঝে রোজগারের উপকরণ বিতরণ করবেন। মানুষের মাঝে রোজগারের সম্বল বিতরণ করা নবীজির সুন্নত। বৃক্ষরোপণ একটি উত্তম কর্ম। বৃক্ষ আমাদের নানা উপকারে আসে। মানুষ, পশু-পাখীসহ সমস্ত মাখলুক এর উপকার ভোগ করে। তাই সকলকে বৃক্ষরোপনে এগিয়ে আসতে হবে। একটি কদুর বীজও যদি হয় তা রোপণ করবেন। এ থেকেও অনেক নিয়ামত পাওয়া যাবে।
বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমেও ঈসালে সাওয়াব করা সম্ভব। আমাদেরও বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। দেশের যে কোন প্রান্তে এ বর্মসূচি বাস্তবায়নে আমি প্রস্তত আছি। তিনি আরো বলেন, আমি আমার মা-বাবার নির্দেশে মাঝে মাঝে জন্মভ‚মির বিভিন্ন নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করি। দুঃখী মানুষের কাছে যাই, তাদের সাথে মিশি, এতিমদের কথা শুনি, তাদের আবদার পূরণে নিজেকে বিলিয়ে দেবার চেষ্টা করি। কারণ এতিমদের সালাত ও সালাম পাক মদীনায় প্রতিধ্বনিত হয়। আপনারাও এতিমদের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। অন্ধ, আতুর ও বিধবাদের সহযোগিতা করবেন, মিসকিনদের খাবার দেবেন, সম্ভব হলে দরিদ্র এলাকায় চক্ষু শিবির স্থাপন করবেন, মানুষের জন্য পানির ব্যবস্থা করবেন, মসজিদ নির্মাণ করবেন। এতে জান্নাতের পথ সুগম হবে।
তিনি জনপ্রতিনিধিদের উদ্যেশ্যে বলেন, সম্প্রতি যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন বা হন নাই আপনার উভয়ে জনপ্রতিনিধি। কারণ উভয়েরই জনসমর্থন আছে। উভয়ে একে অন্যের সহযোগী হয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে জনখেদমতে নিয়োজিত হবেন। সরকারি অর্থ খাত ওয়ারী খরচ করবেন, গভীর রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণসহ অসহায়ের পাশে দাঁড়াবেন। মাটির আসনে বসার চেষ্টা করবেন, আর এটাই নবীজির শিক্ষা। কেউ খারাপ আচরণ করলে তার সাথে ভালো আচরণ করবেন, দু’আ করবেন আল্লাহ আমার দাম্ভিক মস্তককে অবনত করে দাও। সেটাই হবে কল্যাণের পথ।
পীর-মুরীদি সম্পর্কে তিনি বলেন, পীর-মুরীদির নামে যারা বিদ‘আতে লিপ্ত তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার ওয়ালিদ মুহতারাম সাধাসিধে আসনে বসতেন, তাঁর কোনো গদি ছিল না। তিনি মানুষদেরকে বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সত্য-সঠিক সিলসিলায় আশ্রয় গ্রহণ করার আহবান জানাতেন।
তিনি আরো বলেন, গভীর রাতে নির্জনে রাব্বে কারীমের জন্য দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে দিন, অন্তরের কালিমা দূরীভ‚ত হয়ে যাবে। আমরা চন্দ্র-সূর্যের পূজা করি না, আমরা ন্যাচারালিস্ট নই। আমরা এক আল্লাহর কালিমা পড়েছি। আমরা নবীজির পথ অনুসরণ করি। তাই সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী, স্কুল অব এক্সেলেন্স-এর প্রিন্সিপাল মাওলানা গুফরান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী, মাসিক পরওয়ানার সম্পাদক মাওলানা রেদওয়ান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী ও তায়্যিবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলীর যৌথ পরিচালনায় মাহফিলে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আল্লামা নজমুদ্দীন চৌধুরী ছাহেবজাদায়ে ফুলতলী, দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, মাওলানা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, মুফতী মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, সোবহানীঘাট কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী, বাংলাদেশ আন্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর মহাসচিব মাওলানা এ.কে.এম মনোওর আলী, জালালপুর জালালিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা জ.উ.ম আব্দুল মুনঈম, ফেনী ছাগলনাইয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হোসাইন আহমদ ভ‚ইয়া ও দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিছ মাওলানা বদরুজ্জামান রিয়াদ।
বাদ আসর বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর সভাপতি আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয় দুর্বৃত্তদের আনাগোনা লক্ষ্য করছি। পাঠ্যক্রমে ডারউইনের মতবাদসহ নাস্তিক্যবাদ ঢেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, এটি তার অনুমোদনক্রমে হচ্ছে কিনা। আমাদের বিশ^াস, তিনি জানলে দেশ ও জাতি এমন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। তা নাহলে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনতা এ অপচেষ্টা রূখে দাঁড়াতে পিছপা হবে না। সাবধান করে দিতে চাই, ইসলামী শিক্ষার স্বকীয়তা রক্ষায় আমরা অতীতে লংর্মাচ করেছি, প্রয়োজনে আবার করব, নিজেদের জীবন কুরবান করতেও কুণ্ঠাবোধ করব না। তিনি বলেন, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর প্রতিষ্ঠিত গণসংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে আল-ইসলাহ এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর সকল মুরিদীন, মুহিব্বীনদের সংগঠনমুখী হতে হবে। আমরা কোন লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিতে নয়, নির্বাচনমুখীও নয়, তবে প্রয়োজনে প্রতিটি অঞ্চলে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তিনি শুধু খানেকার পীর ছিলেন না, প্রয়োজনে মর্দে মুজাহিদের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার অনুসারীদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইসলামের সৌন্দর্য রক্ষায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজকে অশ্লীলতামুক্ত, বাজারকে ভেজালমুক্ত, মসজিদের মিম্বরকে গোস্তাখে রাসুল মুক্ত করাসহ সরকারকে ইসলামী নীতির উপরে অটল থাকতে বাধ্য করতে হবে।
তিনি বলেন, হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.) অসংখ্য গুণে গুণান্বিত ছিলেন, নবীর ওয়ারিস হওয়ার জন্য যত গুণ দরকার তা তাঁর মধ্যে ছিল। এজন্য তাঁর জীবনে আকাবীরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পেয়েছি। তিনি যে মাসলাক রেখে গেছেন, তা একক কোন মাসলাক নয় বরং তা আকাবীরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হয়ে স্বয়ং রাসূলে কারীম (সা.)-এর মাসলাক। তাই আমাদেরকে এ মাসলাকের ছায়াতলে আশ্রয়গ্রহণ করে থাকতে হবে। যারা ইসলামের মধ্যে ফিরকা সৃষ্টি করছে তাদের ব্যাপারে সর্বাদা সজাগ থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র.), আকাবীরগণ ও ছাহেব কিবলাহ আমাদেরকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা কাজ করব। তিনি বালাই হাওরে হাজার বছরের স্বপ্ন রেখে গেছেন। তাঁর রুহানী ফয়েজে এ মাহফিল ইসলামী আন্দোলনের এক বিশাল ক্ষেত্র। আমরা যেন এ মাহফিল থেকে মানবতা, ইসলাহ, ইহসান এবং আখলাক চর্চার প্রত্যয় নিয়ে ফিরতে পারি, তাহলে তাঁর যথার্থ সাওয়াব রেসানী হবে। তিনি মাহফিল সফলের লক্ষ্যে প্রশাসনসহ যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানান।
মাহফিলে সম্মানিত অতিথি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মুহাম্মদ আবু জাফর রাজু, ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারী হাফিয মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী ছাহেবজাদায়ে ফুলতলী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি এডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব, সৎপুর কামিল মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা শফিকুর রহমান, ইছামতি কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাশুক আহমদ, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রহীম, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা নূরুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মোশাহিদ আহমদ কামালী, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর সহ-সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা ছরওয়ারে জাহান, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা মঈনুল ইসলাম পারভেজ, সৎপুর কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবূ জাফর মুহাম্মদ নুমান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মাওলানা শামসুল ইসলাম, মাথিউউরা সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল আলিম, বুরাইয়া কামিল মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী, লিডিং ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফজলে এলাহী মামুন, ঢাকা জেলা লতিফিয়া কারী সোসাইটির সভাপতি মাওলানা আবু সাদেক মুহা. ইকবাল খন্দকার, সিলেট জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আলহাজ্ব শেখ মকন মিয়া প্রমুখ।
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আবূ ছালেহ মুহাম্মদ কুতবুল আলম, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাওলানা নজমুল হুদা খান, তালামীযে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. দুলাল আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মোজতবা হাসান চৌধুরী নুমান প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন