নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। এই নিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭৩। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। ইসির হিসাবে ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশের মতো। উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের ভোট হয়নি। চলতি ইউপি নির্বাচনে যেখানে ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, মারামারি, হানাহানি, খুন-জখম অনেকটাই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। নির্বাচনের আগের ১৮ দিনে কোনো অঘটন, সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। কোথাও পেশীশক্তির প্রদর্শন লক্ষ করা যায়নি। মানুষ বিনা বাধায়, বিনা হুমকিতে, কোনো ভয়-শংকা ছাড়াই ভোট দিয়েছে। আমাদের দেশে ভোট কেবল ভোট নয়, উৎসবও, অনেক দিন পর সেটা এই নির্বাচনে দেখা গেছে। ইসির ব্যর্থতা, অকর্মন্যতা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের একদেশদর্শিতা ও হস্তক্ষেপ, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের যে কোনোভাবে, সন্ত্রাস করে হলেও বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি জনগণের মধ্যে ভোট সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলেছে। ভোটের ঐতিহ্য ও রাজনীতি মূল্যহীন হয়ে পড়ার এই বাস্তবতায় নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, সকল পক্ষ চাইলে এখনো অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন; ‘বিগত ৫ বছরে যতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, আমার বিবেচনায় আমাদের প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বোত্তম।’ পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা তার বক্তব্যকে সমর্থন করতে দ্বিধা করবেন বলে মনে হয় না। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের ধন্যবাদ প্রাপ্য। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সন্ত্রাসমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ এ নির্বাচন ভবিষ্যতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়।
নির্বাচনের ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়। সেলিনা হায়াৎ আইভী অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রার্থী। বিগত দুই মেয়াদে তিনি সিটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সফলভাবে। ২০১১ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি শামীম ওসমানকে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। তখন অবশ্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতো না। পরবর্তীতে দলীয় ও দলের প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু হলে ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াৎ হোসেনকে পরাজিত করেন বিপুল ভোটে। এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের অন্যতম উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র হিসেবে মেয়র পদপ্রার্থী হন। যেহেতু দল নীতিগতভাবে এ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সুতরাং যৌক্তিককারণেই তৈমূর আলম খন্দকারের পদ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের কারণে এ নির্বাচনে দল হিসেবে বিএনপির পরাজয় হয়েছে, এমন দাবির কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে- এটাই বলতে হবে। তৈমূর আলম খন্দকার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত আছেন। নারায়ণগঞ্জে নেতা হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে তার জনপ্রিয়তাও কম নেই। বলা হয়ে থাকে, সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা গরীর-দুঃখী-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের যে রাজনীতি করতেন, তৈমূর আলম খন্দকারও সেই রাজনীতি করেন। এক্ষেত্রে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা ছিলেন তার অন্যতম অনুপ্রেরণা। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, এই নির্বাচনে জেতার জন্য সেলিনা হায়াৎ আইভী স্বয়ং ছিলেন সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারকে বেতোয়াক্কা করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। ওই পরিবারটির প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ বিরোধিতাকে মোকাবিলা করে বারবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার বাবার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি সততার অনুসরণও তার মধ্যে রয়েছে। তার জীবনযাপন সাদাসিদে। সহজেই তিনি সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারেন। তিনি একই সঙ্গে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টোলবাজি ইত্যাদির ঘোর প্রতিপক্ষ। মেয়র হিসেবে তার দুই মেয়াদে তিনি সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টোলবাজি, কমিয়েছেন। শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকাংশে প্রতিষ্ঠা করছেন। উন্নয়নও করেছেন এই বিবেচনা সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাকে মেয়র হিসেবে পুনঃনির্বাচিত করেছে। তার বিজয় তার নিজের, দলের, প্রতীকের বিজয় ছাড়াও নারায়ণগঞ্জবাসীর বিজয়।
নির্বাচনটি পুরো ইভিএমএ হয়েছে। এতে নানা বিড়ম্বনায় পড়েছে ভোটাররা অভ্যস্ত না থাকায় অনেকে বিপাকে পড়েছে। কারো আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেনি। ভোট দিতে সময় বেশি লেগেছে। অনেকে ইভিএম-এর কারণে ভোট দিতেই আসেনি। এতে ভোটারসংখ্যা কম হয়েছে। ভোটের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের কর্মী, নির্বাচন সমন্বয়কারী ও এজেন্টদের অনেককে আটক করা হয়েছে, অনেকের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে। ফলে তারা কাজ করতে পারেনি। ভয়নীতি তাদের বিরত করেছে। নির্বাচনবিধি অনেক ক্ষেত্রে লংঘিত হলেও নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করেনি। পুলিশ ও প্রশাসনের এই ভূমিকা ও আচরণ কি এড়িয়ে যাওয়া যেতো না? এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলে নির্বাচনটি আরো সর্বাঙ্গসুন্দর হতো। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই সবশেষ সিটি নির্বাচন। এই নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও ব্যর্থতার কোনো শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে, হুদা কমিশন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত ও ধ্বংস করে দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার শেষ নির্বাচন হলেও একথা বলা যাবে না, সব ভালো যার শেষ ভালো। তবে মাহবুব তালুকদারের ভাষায় ‘সর্বোত্তম’, নির্বাচন হওয়ার এই ধারা আগামীতে সব নির্বাচনে অনুসৃত হবে, এটাই কাম্য। পরিশেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আন্তরিক অভিনন্দন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন