জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি যখন বলছে বাংলাদেশের ৪০ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তখন একটি ইংরেজি দৈনিকের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের উদাসীনতা ও সরকারি দলের প্রভাবশালীদের কারণে প্রতিদিনই কমছে কৃষিজমি। কৃষিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা কৃষিজমি কমছে বলে স্বীকার করলেও ২০০৩ সালের পর থেকে তাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ঐ সালে ইউএনডিপির প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী বাংলদেশ প্রতি বছর ১ ভাগ হারে কৃষিজমি হারাচ্ছে। এ বছর জুলাইয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত আবাসন শিল্প কারখানা, রাস্তাসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কারণে প্রতিদিন কমে যাচ্ছে প্রায় ২২০ হেক্টর কৃষিজমি। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ ১৪ শতাংশ। অপরিকল্পিত ব্যবহার অব্যাহত থাকলে মাথাপিছু এমন জমির পরিমাণ ২০৫০ সালে ৬.২০ শতাংশে নেমে আসবে। চাষের জমির এই ক্রমহ্রাসকে অস্বাভাবিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা ৪৪ বছর আগে ১৯৭২ সালে মাথাপিছু চাষাবাদের জমির পরিমাণ ছিল এক একর ৩৫ শতাংশ। ভূমি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেছেন, জমির যুক্তিযুক্ত ব্যবহার ও সুরক্ষা সম্পর্কিত নির্দেশনা এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৬ প্রণয়নের কাজ চলছে। আইনটি প্রণীত হলে সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে। তবে আইনটি কবে নাগাদ হবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
কৃষিজমি কেন দিন দিন কমছে এ নিয়ে বিস্তারিত বলার কিছু নেই বরং কৃষিজমি কী করে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জাতীয় ভূমি জোনিং প্রকল্পের এক জরিপে বলা হয়েছে, কমে যাওয়া কৃষিজমির মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ আবাসন খাতে, ১৭ ভাগ ইটভাটায়, বাকি তিন ভাগ জমি শিল্প, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে একপর্যায়ে একজন মানুষের চাষের জমি বলতে কিছুই থাকবে না। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। সর্বোপরি অনাকাক্সিক্ষত মহা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে সবাইকে। আবাসন খাতের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্রামাঞ্চলে দিনদিন বসতভিটা তৈরিতে ব্যাপক কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শহরাঞ্চলে আবাসন প্রকল্পের কারণে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি হতদরিদ্র, নি¤œবিত্তদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আবাসন খাতের সঙ্কট নিরসনে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করতে সরকারি প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। গ্রামে বাড়ি বৃদ্ধির হার হ্রাসে পরিকল্পিত উপায়ে আবাসন তৈরি করে কৃষিজমি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তা করা প্রয়োজন। জনে জনে জমি বরাদ্দের পরিবর্তে প্লট দেয়া এবং আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যাতায়াত ব্যবস্থায় সড়ক নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহার নিয়ে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। রেলকে আরো বেশি কার্যকর করা যেতে পারে। নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া গেলে সেক্ষেত্রেও সড়কপথের ওপর চাপ কমে আসা স্বাভাবিক। নৌপথ ও রেলপথকে ব্যবহারের বিষয়টি সক্রিয় ভাবনায় রাখা জরুরি। প্রকাশিত রিপোর্টে যে উদ্বেগজনক বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে তা নিয়ে কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কারণে কৃষিজীবী মানুষ তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিক্রি করতে রাজি না হলে তাদের ঘরছাড়াও হতে হচ্ছে। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে যত আইনই থাকুক না কেন তা থেকে সুফল পাওয়া যাবে না।
খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে কৃষিজমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের অর্থনীতি মূলতঃ কৃষিনির্ভর। কৃষিজমি না থাকলে তার বিরূপ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপর। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মানুষ এখনই বড় ধরনের খাদ্যঝুঁকিতে রয়েছে। সে বিবেচনায় কৃষিজমি হ্রাস যদি ঠেকানো না যায় তবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষিজমি রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ভূমিকা নেয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন