শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রক্ষা করতে হবে প্রবাল প্রাচীর

শাহরীন তাবাসসুম | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

অপার বিস্ময়ের এক ভাণ্ডার সমুদ্র। এই সমুদ্রের উপরিভাগ ও বিশেষত তলদেশের অনেকাংশ সম্পর্কেই এখন পর্যন্ত সম্যক ধারণা অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সমুদ্রের অন্যতম এক বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীর। প্রবাল বা কোরাল জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী কোরাল রিফ গঠন করে থাকে, যা আজ জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণত ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণ সামুদ্রিক এলাকার অগভীর স্থানে প্রবাল জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রবাল প্রাচীর গড়ে তোলে। ২৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং ৬০-৭০ মিটার সামুদ্রিক গভীরতা প্রবাল প্রাচীরের জন্য অত্যানুকূল। প্রবাল অ্যান্থোজোয়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত প্রাণী বিশেষ। এক একটি প্রবাল প্রাণীকে পলিপ বলা হয়। হাজার হাজার পলিপ সমুদ্রের তলদেশে কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। গড়ে তোলে প্রবাল প্রাচীর। পলিপগুলো মারা যাওয়ার পর সেই স্থানে জায়গা নেয় নতুন পলিপ। এভাবেই প্রবাল প্রাচীরের আকার বৃদ্ধি পায়।

প্রবাল প্রাচীর বিভিন্ন বর্ণের হতে পারে। যেমন বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি। প্রাচীরে বসবাসকারী শৈবাল, অ্যালজি, স্পঞ্জ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন উপাদানের রঙ এই বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী। এর আকারও বিভিন্ন হতে পারে। কোনটা মৌমাছির চাকের মতো, কোনটা হরিণের শিংয়ের মতো আবার কোনটা মানুষের মস্তিষ্কের মতো হয়। প্রবাল ক্ষরিত ক্যালসিয়াম কার্বনেটের বিভিন্নতার জন্যই এমনটি হয়ে থাকে। এক একটি প্রবাল প্রাচীরে প্রায় ১০ লক্ষ প্রবাল পাওয়া যায়। তাই প্রবাল প্রাচীরকে ‘সমুদ্রের বৃষ্টি অরণ্য’ বলা হয়ে থাকে।

গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও সমুদ্রের অগভীর তলদেশ ছাড়াও গভীর সমুদ্র বা নাতিশীতোষ্ণ ও শীতপ্রধান দেশের সমুদ্রেও কিছু প্রবাল প্রাচীর দৃষ্টিগোচর রয়েছে। সাগরের পরিষ্কার ও তরঙ্গ আন্দোলিত পানি প্রবালের পক্ষে অনুকূল। পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, উপকূলীয় প্রবাল প্রাচীর, ব্যারিয়ার প্রবাল প্রাচীর, অ্যাটল জাতীয় প্রবাল প্রাচীর, ব্যাঙ্ক প্রবাল প্রাচীর, প্যাঁচ প্রবাল প্রাচীর, রিবন প্রবাল প্রাচীর ইত্যাদি। পৃথিবী বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। ২৯০০টি ক্ষুদ্রতর প্রাচীর এবং ৯০০টি প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৬০০ কিলোমিটার। এশিয়ার বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর হলো লোহিত সাগরীয় প্রাচীর, যা সমুদ্রের শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা পরিবর্তন সহ্য করার ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। প্রবাল প্রাচীরগুলো বছরে প্রায় ১-৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে এক সময় তা দ্বীপে পরিণত হয়। যাকে বলা হয় প্রবাল দ্বীপ বা কোরাল আইল্যান্ড। আমাদের সেন্টমার্টিন তেমনি একটি প্রবাল দ্বীপ, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য।

প্রবাল প্রাচীর সমুদ্রের তলদেশের মাত্র ০.১% জায়গা জুড়ে বিরাজমান। তবে প্রবাল রাজ্যেই সমুদ্রের ২৫% প্রাণী বসবাস করে এবং জীবন ধারণ করে থাকে। প্রবাল হলো উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক অপূর্ব সম্মিলন। প্রবালের দেহে এক অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ বাস করে, যা সূর্যের আলোর সাহায্যে ৯০% খাদ্য উৎপাদন করে। প্রবাল প্রাচীর থেকে খাদ্য সংগ্রহ ছাড়াও আশ্রয় ও প্রজননের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় ৪০০০ প্রজাতির মাছ। এছাড়াও অ্যালজি, ফাইটোপ্লাঙ্কটন, জুয়োপ্লাঙ্কটন, চিংড়ি, কাঁকড়া, বিভিন্ন মোলাস্ক জাতীয় প্রাণী, লবস্টার, ওয়ার্মস, সি-অ্যানিমোন, স্টারফিস, স্কুইড, অক্টোপাস, স্পঞ্জ, ম্যানাটি, ডুগং, ডলফিন, কচ্ছপ, সাপসহ অন্যান্য অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ কোরালের উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে। অতুলনীয় প্রাণিবৈচিত্র্যের জন্য প্রবাল প্রাচীরকে ‘সমুদ্রের বৃষ্টিবন’ বলা হয়।

শুধুমাত্র উদ্ভিদ ও প্রাণীকে খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করা ছাড়াও প্রবাল প্রাচীর অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের এক ভাণ্ডার। প্রবাল প্রাচীরের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। অনেক সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ আছেন, যারা প্রবাল প্রাচীরসহ সমুদ্রের তলদেশের সৌন্দর্য অবলোকন করতে চান তাদের জন্য স্কুবা ডাইভিংয়ের ব্যবস্থা করে অনেকে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও প্রবাল প্রাচীর সম্বলিত স্থানগুলো পর্যটনের জনপ্রিয় কেন্দ্র। অলংকার শিল্পেও আকর্ষণীয় বর্ণের কোরাল ব্যবহার করা হয়। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, প্রবাল থেকে অ্যালঝাইমার্স, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দূরারোগ্য রোগের ঔষধ তৈরি করা সম্ভব। অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রবাল ও প্রবাল প্রাচীরের রয়েছে প্রাকৃতিক গুরুত্বও। প্রবাল প্রাচীরগুলো ঢেউ ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত থেকে উপকূলীয় ভূমিকে ক্ষয় হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। ধারণা করা হচ্ছে যে, কোরাল রিফ থেকে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কসংকেত পাওয়া সম্ভব। এতে করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই হ্রাস করা যেতে পারে। এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার কাজ চলমান রয়েছে।

বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৪৮,০০,০০,০০০ বছর আগে সমুদ্রে প্রবালের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রবাল প্রাচীরগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপে আসতে হাজার হাজার বছর সময় লাগে। বর্তমান রিফগুলো প্রায় ১০,০০০ বছর পুরোনো, যা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮১ সালে ইউনেস্কো অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, যা ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩,৪৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর, যা মহাশূন্য থেকেও সুস্পষ্ট চিহ্নিত করা যায়, তা বিলুপ্তির তালিকায় প্রথমদিকেই স্থান করে নিয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রী বিরাজমান থাকলেই প্রবালের উদ্ভিদ কোষের মৃত্যু ঘটে। উচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি হলে পলিপগুলো মৃত্যুবরণ করে। এছাড়াও স্টারফিশদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে প্রবাল। ফলে স্টারফিশের বংশ বৃদ্ধির ফলেও প্রবাল প্রাচীর এখন সঙ্কটের মুখে। প্রবাল প্রাচীরের উপর নির্ভরশীল সকল মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীও এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে ফলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হবে ব্যাপকহারে। এতে করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে গোটা সামুদ্রিক প্রকৃতি। গবেষণা হতে প্রাপ্ত, গত ৩০ বছরে পৃথিবীর প্রায় ৫০% প্রবাল প্রাচীর নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৯০% প্রবাল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিছু বিজ্ঞানীদের মতে, চলতি শতাব্দীর মধ্যেই পৃথিবীর সকল প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্ব বিলীন হবে।

শুধুমাত্র তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও স্টারফিশ এর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই নয় বরং কোরাল রিফ ধ্বংস ত্বরান্বিত করার পেছনে রয়েছে মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণ। উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে কৃষিকাজে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে তা পানিতে মিশে কোরাল ব্লিচিং ত্বরান্বিত করে। এই অবস্থায় কোরালগুলো সাদাটে হয়ে অতঃপর মারা যায়। তাছাড়া কলকারখানার বর্জ্য ও প্লাস্টিক আবর্জনা থেকে সমুদ্র দূষণ বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পর্যটকদের ব্যবহৃত সানস্ক্রিন থেকেও রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মিশে নষ্ট করছে প্রবাল প্রাচীর বৃদ্ধির অত্যানুকূল পরিবেশকে।

প্রবাল প্রাচীর রক্ষার্থে অনুকূল পরিবেশ প্রদান করার লক্ষ্যে সার্বিক চেষ্টা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও মৃতপ্রায় প্রবালকেও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সংরক্ষণের সুবিধার জন্য একে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, মেরিন পার্ক, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটসহ বিভিন্ন ট্যাগে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমিয়ে আনতে হবে। সামুদ্রিক প্রবালখেকো তারা মাছের সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য যেন সমুদ্রের পানিকে দূষিত করতে না পারে তা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ও জৈব পদার্থ ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। অনেক দেশে আইন করে প্রবাল প্রাচীর সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে নতুন করে গড়ে তুলতে এবং পানির স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও মহাদেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রবাল প্রাচীরে তাপমাত্রা ও পরিবেশের অন্যান্য নিয়ামক অনুকূলে রয়েছে, যাকে সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যবাহী প্রবাল প্রাচীরকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

কোরাল ব্লিচিংয়ের ফলে কোরাল রিফের কোরাল বা প্রবাল এবং এর ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী বিপন্ন হয়ে পড়ছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ খাদ্য ও জীবিকার জন্য এর উপর নির্ভর করে থাকে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ঔষধ প্রবাল থেকেই আসে। ফলে প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হলে জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের মুখে এসে পড়বে। তাই প্রবাল প্রাচীর রক্ষার্থে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা অবশ্যই পালন করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন