কোভিড-১৯ সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং শিক্ষাখাত সর্বত্রই এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা ও কার্যকর দিকনির্দেশনার কারণে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের এ তিনটি খাত ততোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো। করোনা ভাইরাসের বিপজ্জনক নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে সব দেশকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। করোনা মহামারির নতুন উদ্বেগের নাম ওমিক্রন। বিশ্বে আবারও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। ওমিক্রন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সংক্রমণ আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার নতুন ধরনের এ অতিসংক্রমণ প্রবণতাকে ‘সুনামি’ আখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশেও ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে করোনা। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে প্রবেশ করছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এতে দেশ বেশ ঝুঁকির মধ্যেই আছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিবেশী ভারতেও করোনার নতুন ধরন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে শুরু হয়েছে তৃতীয় ঢেউ।
এখন দৃশ্যত কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নেই। অবাধে মিশছে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের সঙ্গে। দাওয়াতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, সেমিনারে আলোচনা সভায় অংশ নিচ্ছে। বিমানে-বাসে-ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ ফের বাড়ার পেছনে এর একটা যোগসূত্র রয়েছে বলে আমরা মনে করি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা সংক্রমণ, শত শতাংশেরও বেশী বেড়েছে। সংক্রমণের হার এক শতাংশ থেকে প্রায় একুশ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত জেনোম সিকোয়েন্সিং না করলে ওমিক্রনের বিস্তার কেমন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ শুরু হয়েছে কিনা, তা বোঝাটা মুশকিল। জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে দেশে ওমিক্রন বড় মাত্রায় আঘাত হানতে পারে। সেটি সামাল দিতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটুকু প্রস্তুত সেটিই বিবেচ্য বিষয়। লকডাউনের বিপরীতে ওমিক্রন ঠেকাতে জনচলাচলে কিছু বিধিনিষেধ ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ মাত্রায় দ্রুত অবনতি ঘটলে কীভাবে সামাল দেবে, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবে, এ সম্পর্কে তৎপরতা আমরা এখনও খুব একটা দেখছি না। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াটাই এখন জরুরি। বিগত সময়ে আমাদের স্বাস্থব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্রই ফুটে উঠেছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্বল্প সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও মানুষ চিকিৎসা পায়নি। কোথাও একটা শয্যা খালি নেই। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নেই। আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নেই। এটা ছিল এক সাধারণ চিত্র। ফলে শুধু কোভিড রোগী নয়, নন-কোভিডের চিকিতৎসাও ব্যাহত হয়েছিল। বিশেষ করে প্রসূতি ও শিশুসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল। কোভিড রোগী আর নন-কোভিড রোগীকে কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে, কোথায় দেওয়া হবে, তার জন্য ছিল না সুসমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা। এতে হাসপাতালে এসেও অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিল। চিকিৎসা ছাড়াও কোভিড পরীক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের দোদুল্যমানতা ছিল।
কোভিড সংক্রমণের বিস্তার রোধের প্রাথমিক করণীয় হিসাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বারবার তাগিদ সত্ত্বেও দ্রুত বিপুলসংখ্যক মানুষের কোভিড পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রথম দিকে শুধু সরকারি সংস্থার হাতেই পরীক্ষার এখতিয়ার সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে পরীক্ষার অনুমোদন দিতে পার হয়েছিল দীর্ঘ সময়। সরকারি তরফেও পর্যাপ্তসংখ্যক পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ চলেছিল ঢিমেতালে। তার মধ্যে কতগুলো বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে কোভিড পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যারা ভূয়া রিপোর্ট দেওয়ার কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল। এতে বহির্বিশ্বে সংকটে পড়েছিল দেশের ভাবমূর্তি।
আরও হতাশাজনক দৃশ্যপট হলো, দুর্যোগের মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ ছিল না। এন-৯৫ মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা ও বিতরণের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। মোটাদাগে স্বাস্থ্য খাতে এক বিশৃঙ্খল, নৈরাজ্যিক চিত্র দেখা গিয়েছিল, যার পুনরাবৃত্তি আর কাম্য নয়। সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতাকে এখন কাজে লাগেতে হবে। গত সেপ্টেম্বর থেকে দ্বিতীয় ঢেউ দেশে অনেকটা নিষ্প্রভ হওয়া শুরু করেছিল। সংক্রমণ আস্তে আস্তে কমে আসছিল। এখন আবারও যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে সার্বিক বিষয়ে জরুরি ভিত্তেতে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে জনগণের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী, ওষুধ, আবশ্যকীয় উপকরণ মজুদ বাড়াতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষায় প্রয়োজনীয়, রি-এজেন্ট, ভেন্টিলেটরসহ অন্য আবশ্যকীয় চিকিৎসা পণ্য দেশে মজুদ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।
মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক- কলামিস্ট
মোবাইল-০১৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন