কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত হলো ইসলামের মূল ভিত্তি। এগুলো মুসলিম জীবনের মৌলিক ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের একাধিক নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম মৌলিক ইবাদাত সম্পর্কিত আয়াত নাজিল করেননি। তিনি সর্বপ্রথম এসব বিধানের পূর্বে পড়ালেখার আয়াত নাজিল করেছেন। আল কুরআনের সর্বপ্রথম নাজিলকৃত আয়াত হলো, ‘আপনি আপনার প্রভুর নামে পড়ুন’ (সুরা আলাক: ১)। অর্থাৎ কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব ও যাকাতের নির্দেশ প্রথমে আসেনি। নির্দেশ এসেছে পড়ালেখা করার এবং খাতা-কলম প্রস্তুত করার। এ আদেশ দ্বারা ইসলাম লেখাপড়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। কারণ উক্ত ইবাদাতগুলো সম্পন্ন করতে সর্বপ্রথম বিষয়গুলোর যথাযথ জ্ঞান প্রয়োজন। নির্দেশিত ইবাদাতগুলোর নিয়ম না জেনে তা যথাযথ পালন করা সম্ভব নয়। ইসলামে তাই শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। মহানবী (স.) এর আগমনের যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয়ে থাকে। ওহীপ্রাপ্তির পর তিনি ঘোষণা করেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা সকল মুসলিমের উপর ফরজ’ (ইবনু মাজা: ২২৪)। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। আর এ ব্যবস্থায় জীবনের সকল দিক ও বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামে রয়েছে নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাতের বিধান। রয়েছে ফরজ, ওয়াজিব, হালাল ও হারামের সুস্পষ্ট বর্ণনা। রিসালাত, শরী‘আত ও আখিরাত সম্পর্কে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা। পাশাপাশি এ বিধানে রয়েছে যুগসন্ধিক্ষণের চাহিদা মোতাবেক সব ধরণের জ্ঞান অর্জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ। রয়েছে উন্নত জ্ঞান-গবেষণার ইঙ্গিত। ইসলামী এ ব্যবস্থা সকল কালের, সকল যুগের ও সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। ‘আল কুরআন বিশে^র সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য হিদায়াত বা গাইড লাইন’ (সুরা আল বাকারা: ১৮৫)।
সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি ও গোষ্ঠির সামষ্টিক জীবন পরিচালনা করতে বিভিন্ন উপাদনের প্রয়োজন ছিল। এসকল উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো পার্থিব বিভিন্ন জ্ঞান। প্রত্যেক যুগেই প্রত্যেক ধর্মের মানুষ সমকালীন প্রয়োজনীয় জ্ঞানের দ্বারস্থ হয়েছিল। আর প্রত্যেক যুগে কিছু খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও আবিস্কারকের আগমন ঘটেছিল। ৬১০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী এক হাজার বছর সময়টি ছিল মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগ। এ বৃহৎ সময়কালে মুসলিমদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন অসংখ্য ক্ষণজন্মা প্রাণপুরুষ। তাফসীরের জগতে আগমন করেছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)। হাদীসের জগতে জন্ম নিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা.)। ফিকহ শাস্ত্রে জন্ম নিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) ও যায়েদ বিন ছাবিত (রা.)। সমরবিদ্যায় বিচক্ষণ কৌশলী ছিলেন সালমান ফারসী (রা.)। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রসিদ্ধ ডাক্তার ছিলেন হারেস ইবনে কালদাহর (রা.)। মহানবী (স.) এর অনেক সাহাবী (রা.) বৈচিত্র জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আরো অসংখ্য নবীর আগমন ঘটেছিল। তারাও সমকালীন জ্ঞানের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন মর্মে আল কুরআন ও হাদীস সাক্ষ্য দেয়। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আগমন করেন বিশিষ্ট নবী যাকারিয়া (আ.)। তিনি ছিলেন সমকালীন যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কাঠমিস্ত্রি। ‘তিনি কাঠ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ঘর ও ফার্নিচার তৈরী করতেন’ (মুসলিম: ৬৩১২)। খৃষ্টপূর্ব ৪ হাজার বছর পূর্বে আগমন করেন নূহ (আ.)। নূহ (আ.) কর্তৃক সর্বপ্রথম সুবিশাল নৌকা বানানোর ঘটনা বিশ^ময় প্রচারিত একটি দুর্লভ ঘটনা। ইব্রাহীম আর ইসমাঈল (আ.) দু’জন নবী একত্রে ইট, পানি আর বালু দিয়ে কা‘বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। নবীগণ (আ.) এবং সাহাবাগণের (রা.) জীবনের এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য পার্থিব জ্ঞান অপরিহার্য। যুগে যুগে অসংখ্য নবীর আগমন ঘটেছিল। প্রতিটি যুগে সভ্যতার শিক্ষক ছিলেন সমকালীন নবী ও রাসুল (আ.)।
আর সভ্যতা মানেই হলো জ্ঞানের আধুনিকায়ন ও নতুন কিছু আবিষ্কার। সময়ের বিবর্তনের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। আর মানবজাতির মাঝে যিনিই এ কাজে এগিয়ে এসেছেন তিনিই সাফল্য পেয়েছেন। নির্দিষ্ট জাতি ও গোষ্ঠির সাথে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। উল্লেখ্য যে, সকল নবীর প্রচারিত জীবনদর্শনের নাম ছিল ইসলাম। সর্বশেষ নবীর প্রচারিত জীবনদর্শন শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই এ জীবনদর্শনে রয়েছে সময় ও কালোপযেগিী সকল জ্ঞানের ইঙ্গিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী শক্তি ও পালিত ঘোড়ার দল প্রস্তুত রাখো। যার দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রুদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখবে’ (সূরা আনফাল: ৬০)। ‘শক্তি’ দ্বারা এখানে সময়োপযোগী ও যুগোপযোগী সমরাস্ত্রের কথা হয়েছে। এখানে কুরআন নাযিলের সময়কার সমরশক্তিকে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। বরং উল্লেখ করা হয়েছে আরবি শব্দ ‘কুঅ্যত’। আল-কুরআনে ব্যবহৃত এ শব্দটি ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে থাকে। শব্দটি দ্বারা প্রাচীন যুগের তীর-ধনুক ও তলোয়ারকে বুঝায়। আবার মধ্যযুগে আবিষ্কৃত বন্দুক, কামান ও তোপকে বুঝায়। আর বর্তমানকালের যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক বোমা, মিসাইল, সাবমেরিন, ড্রোন ইত্যাদি সমরাস্ত্রও এর অন্তর্ভুক্ত। আবার ভবিষ্যতে আবিষ্কৃতব্য সমরাস্ত্রও এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি লোহা নাযিল করেছি, আর তাতে আছে প্রচুর শক্তি আর মানুষের জন্য রয়েছে উপকারিতা’ (সুরা আল হাদীদ: ২৫)। এ আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের কথা নির্দেশ করা হয়েছে। দাউদ (আ.) লোহা দিয়ে পোশাক তৈরি করতেন মর্মে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে (সুরা আম্বিয়া: ৮০)। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা এক তীর দিয়ে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এক. যে ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য তীর বানায়, দুই. শিকারের জন্য যে তীর নিক্ষেপ করে ও তিন. তীর নিক্ষেপে যে সাহায্য করে। তিনি আরো বলেন, ‘তীর নিক্ষেপ ও ঘোড় সওয়ারির প্রশিক্ষণ দাও। তবে আমার কাছে তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ ঘোড় সওয়ারের প্রশিক্ষণ থেকে উত্তম’ (তিরমিযী: ১৬৩৭)।
বাংলাদেশে দু ধরণের শিক্ষা রয়েছে। একটি হলো মাদরাসা শিক্ষা, অন্যটি স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা। এদেশে মাদরাসা শিক্ষাকে ইসলামী শিক্ষা বলা হয়ে থাকে। আর সর্বাধিক প্রচলিত স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষা বলা হয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত রয়েছে আধুনিক বিভিন্ন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাক্টিক্যাল বিষয় ও নানা আবিষ্কারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গোটা বিশে^র সার্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নত আবিস্কারের ধারণা রয়েছে এ শিক্ষায়। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে তৈরি হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টারইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, আধুনিক এসকল শিক্ষাব্যবস্থা কি ইসলামী শিক্ষার বাইরে? বর্তমান যুগে তাফসীর, হাদীস এবং ফিকহ চর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যদিন কুরআন, হাদীস এবং ফিকহ শাস্ত্রের উপর নিত্য নতুন অনেক গ্রন্থ রচিত হচ্ছে। নামকরা অনেক মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ সৃষ্টি হচ্ছেন। তারা কুরআন-হাদীস ও ফিকহ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে মুসলিম-অমুসলিম ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। কিন্তু তারা বিজ্ঞান বিষয়ে কোনো গবেষণা করছেন না। তাদের বিজ্ঞানবিমুখতার কারণে মুসলিম কিশোর-কিশোরীগণ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। এসব আধুনিক ইসলামপ্রিয় তরুণরা আলিমদের কাছ থেকে হাজারো যুগ জিজ্ঞাসার জবাব পেতে চায়। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে জবাব পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। আবার কোনো কুরআন গবেষক যদি বিজ্ঞানের উপর কথা বলতে চান সেখানে তারা নিরুৎসাহিত করছেন। এসব কারণে তরুণরা ইসলামের নামে সৃষ্ট নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। মুসলিমদের অনেকে একদিকে আধুনিক শিক্ষাবিমুখ নীতি অবলম্বন করেছেন, অন্যদিকে নিজের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের দামী ল্যাপটপ ক্রয় করছেন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি মোবাইলটিও ব্যবহার করছেন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইমেইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। এখানে সুস্পষ্ঠভাবে তিনি দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে চলেছেন।
কুরআন ও হাদিস শরীফে জ্ঞান অর্জনের কথা বলা হয়েছে। সূরা আল বাকারাতে আদম (আ.)কে আল্লাহ সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন মর্মে বর্ণিত হয়েছে (সূরা আল বাকারা: ৩১)। আল কুরআনে উল্লেখিত আয়াতে জ্ঞানের কোনো শ্রেণীবিন্যাস করা হয়নি। উক্ত আয়াত জাগতিক ও ইসলামী জ্ঞান বলে পার্থক্য নির্দেশ করেনি। আর জাগতিক জ্ঞান হলেও এটা ইসলামী জ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত। আল-কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত জাগতিক জ্ঞান, ইসলামী জ্ঞানের বাইরে হতে পারেনা। ইসলামের প্রাথমিক সোনালী যুগে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধর্মীয় ও আধুনিক বলে পার্থক্য করা হয়নি; দুই নামে শ্রেণীবিভাগও করা হয়নি। আল কুরআন ও আল হাদীসের জ্ঞানের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাহাবী, তাবেয়ী ও তৎপরবর্তী ইমামগণ গোটা বিশ্বে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন। সাহাবী পরবর্তী যুগে তাফসীর জগতে আগমন করেছিলেন ইবনে কাছীর (র.), ইমাম কুতুবী (র.), ইমাম জাফর সাদিক (র.)সহ প্রমুখ অসংখ্য মুফাসসির। হাদীস শাস্ত্রে জন্ম নিয়েছিলেন ইমাম বুখারী (র.), ইমাম মুসলিম (র.), ইমাম নাসাঈ (র.), ইমাম তিরমিজি (র.) ও ইমাম আবু দাউদ (র.)-এর মত জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস। ফিকাহ শাস্ত্রে জন্ম নিয়েছিলেন ইমাম আবু হানিফা (র.), ইমাম শাফেঈ (র.), ইমাম মালেক (র.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.)। চিকিৎসাবিদ্যায় আগমন করেছিলেন ইবনে সিনা (র.), আল-বিরুনী (র.), হাসান ইবনে হাইসাম (র.), আলী ইবনে রাব্বান (র.)সহ প্রমুখ মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী। জন্ম নিয়েছিলেন আল-ফারগানী (র.), যিনি ছিলেন ফলিত প্রকৌশলের অগ্রদূত। জাবের ইবনে হাইয়ান (র.) ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের জনক। আলকেমিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী, প্রকৌশলী, দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবেও তার খ্যাতি বিশ্বময়। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তাফসীর, হাদীস এবং ফিকহ চর্চার ধারা আজও অব্যহত আছে। কিন্তু থমকে গেছে ইবনে সিনা (র.), জাবির ইবনু হাইয়ান (র.) ও আল বেরুনীদের (র.) রেখে যাওয়া আবিস্কারের ফর্মুলা। অবশ্য এ থমকে যাওয়ার পিছনে রয়েছে দুঃখজনক ঐতিহাসিক কিছু কারণ।
মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে পরবর্র্তী প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী মুসলিমরা রাজ্যজয়, রাজ্যশাসন ও জ্ঞানবিস্তারে বিশ^ময় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। দীর্ঘ এ শাসনক্ষমতার সময়কালে মুসলিমশাসকদের মাঝে পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব জন্ম নেয়। তারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক নানা বিভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিভাজন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসময় কিছু জ্ঞানী মানুষ ঝামেলা এড়াতে নির্জনে অবস্থান গ্রহণ করাকে উত্তম মনে করেন। অন্যদিকে রাজনীতিকগণ ক্ষমতার লোভ ও নানা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেন। ইসলামের সঠিক প্রচার থেকে তারা দূরে সরে যান। কিন্তু জ্ঞানপিপাসু কিছু মুসলিম তাদের জ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যান। তারা জ্ঞানের এ চর্চা থেকে ফিরে আসেননি। বিজ্ঞানী টাইসন বলেন, ‘আমরা আকাশে যে, তারকাগুলো দেখছি, সেগুলোর মধ্যে অসংখ্যা তারকার নাম আরবিতে। মুসলিমরাই এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। তারাই এগুলোর নাম দিয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বীজগণিতের ইংরেজি নাম হলো আল-জেবরা এটা মূলত: আরবি শব্দ, যা মুসলিমরা আবিষ্কার করেছেন। আমরা কম্পিউটারের জন্য যে, অ্যালগরিদম ব্যবহার করি, এটিও একটি আরবি শব্দ। এগুলো মুসলিমদেরই আবিষ্কার।’
কিন্তু মুসলিমদের আদর্শিক পতনের পাশাপাশি ১৯০০ শতকে যখন ভৌগলিক পতন শুরু হয় তখন তাদের বিজ্ঞান চর্চার পতনও শুরু হয়। এসময় ইউরোপ থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হয়। প্রথম বিশ^যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে, অটোমান সাম্রাজ্যকে ইউরোপ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। তারা প্রতিটি মুসলিম ভূমিকে কলোনিতে রুপান্তর করে। এর ফলে চূড়ান্তভাবে মুসলমানদের কোমর ভেঙ্গে যায়। মুসলিমরা তাদের ভূমিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা পায়। এক শতকের মাথায় পুরো মুসলিম জাতিকে তারা মূর্খ জাতিতে পরিণত করে। ভৌগোলিক আর জ্ঞানের রাজত্ব তখন ইউরোপীয়দের হাতে চলে যায়। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। ইউরোপীয় খ্রীস্টানরা মুসলিমদের এ মেরুদন্ড সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে দেয়। সুস্থ মেরুদন্ড নিয়ে মুসলিমগণ আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে তারা দাসত্বের শিকলে বন্দী রাখে। সে বন্দিত্ব থেকে তারা আজও মুক্ত হতে পারেনি। ইউরোপীয়দের পরিচালিত চতুর্র্মুখী হামলা মুসলিমদেরকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কৌশলের কাছে মুসলিমরা পরাজিত হয়েছে। পরাজিত মুসলিমরা আজ বড়ই নির্জিব আর ক্লান্ত। সেই থেকে মুসলিম জাতি আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অগত্যা মুসলিমরা আজ নিজ গোষ্ঠির সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। এই মোক্ষম সুযোগ ইউরোপ-আমেরিকা নিয়েছে তারা নিজেদের অস্ত্র তৈরির নীতি বেগবান রেখেছে। আর মুসলিম দেশকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গলাটিপে ধরেছে। এসব দ্বৈতনীতি মোকাবেলা করার সক্ষমতা মুসলিম দেশগুলো এখনো অর্জন করতে পারেনি। এভাবেই মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে দুটি জ্ঞানের বিভাজনের বিস্তার ঘটেছে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন