নির্বিচারে বন ধ্বংসের কারণে খাদ্য ও আবাসস্থল কমে যাওয়ায় অনেক প্রাণীর বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশে দিন দিন হাতি ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে হাতি হত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা হচ্ছে, দলবেঁধে হাতি বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামে হামলা চালালে মানুষ তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মেরে ফেলছে। বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৩৮টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে ৭টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এদের বেশিরভাগই মানুষের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে হাতির আক্রমণে গত দুই দশকে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, হাতির আক্রমণে যেমন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তেমনি মানুষও হাতি মারছে। এই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে হাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হাতি কেন অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে আসছে? এ প্রশ্নের জবাবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং সেখানে তাদের খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তখনই জীবন বাঁচাতে খাদ্যের সন্ধানে তারা লোকালয়ের দিকে ধাবিত হয়। বন্যপ্রাণীর জীবনধারা স্বাভাবিক রাখতে পারলে তাদের লোকালয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে না। এক্ষেত্রে বনবিভাগ ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। বন্যপ্রাণী যাতে নির্বিঘ্নে বনে বসবাস করতে পারে, এ ব্যবস্থা তাদের নিতে হবে।
বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এশীয় প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ বয়সী হাতির সংখ্যা ২৫০-এরও কম। এটি উদ্বেগপূর্ণ চিত্র। এর মাধ্যমে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে হাতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে। হাতির বেশিরভাগই সীমান্তবর্তী ও পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায়। শেরপুর জেলার সীমান্ত ঘেঁষা তিনটি উপজেলা শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ি ও ঝিনাইগাতিতে শতাধিক বন্যহাতি বসবাস করছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়া ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে কিছু হাতি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গা দখল করে স্থানীয়রা চাষাবাদ করছে। এতে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় বন্যপ্রাণীর বিপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বাঘ ও হাতিসহ অন্যান্য প্রাণী খাদ্যের জন্য লোকালয়ে আসছে। হাতির দল লোকালয়ে এসে ফসলীসহ ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হাতি সাধারণত আগ্রাসী প্রাণীর পর্যায়ভুক্ত নয়। বিশেষ কারণ ছাড়া এটিকে হিংস্র হতে দেখা যায় না। তারা দলবেঁধে বনে বিচরণ করতে পছন্দ করে। বিভিন্ন সময়ে হিংস্র হয়ে লোকালয়ে এসে হাতির আক্রমণের মূল কারণ তাদের অভয়রাণ্য কমে যাওয়া। একশ্রেণীর মানুষ গাছপালা কেটে অভয়ারণ্য উজাড় করে দিচ্ছে। এতে শুধু হাতি নয়, অন্যান্য বন্যপ্রাণীও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। হাতি বা অন্যকোনো বড় প্রাণী যাতে লোকালয়ে আসতে না পারে, এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার সীমানায় সোলার ফেন্সিং বা বৈদ্যুতিক বেড়া দেয়া হয়। হাতি লোকালয়মুখী হলেও কারেন্টের মৃদু শক খেয়ে যাতে বনে ফিরে যায় এজন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। বন্যপ্রাণী তখনই লোকালয়মুখী হয় যখন তাদের বসবাসের জায়গা অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এ সমস্যার নিরসন করা না হলে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এই ঠেকাতে গিয়ে তাদের ওপর যে হামলা ও হত্যা করা হয়, তাতে প্রাণীটির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা-এ প্রবাদের মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে, প্রাণীটি কতটা মূল্যবান। আমাদের অবিবেচনা ও সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে লাখ টাকা মূল্যের প্রাণীটি বিরল হয়ে উঠবে, এটা হতে পারে না।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তর্নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুধু মানুষের ওপরই পড়ছে না, বন্যপ্রাণীর ওপরও পড়ছে। ইতোমধ্যে অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে। হাতি তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে হাতির যে সংখ্যা এবং যেভাবে কমছে, তাতে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এর বিলুপ্তি ঘটতে বেশি সময় লাগবে না। বিশ্বের বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল আমাদের দেশে। এ প্রাণীর সংখ্যাও দিন দিন কমছে। উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, খাদ্যসংকট এবং চোরাকারবারিদের শিকারের কারণে এটি বিলুপ্তির পথে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে হয়েছে চারশ’র মতো। যেভাবে পরিবেশ ধ্বংস ও নিধন প্রক্রিয়া চলছে, তাতে হাতি ও বাঘের বিলুপ্তি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও জাতিসংঘ কাজ করছে। অনেক দেশেই বন্যপ্রাণী হত্যা আইন করে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা বন্যপ্রাণী সররক্ষায় আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে। আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী আইন থাকলেও তা খুব একটা প্রয়োগ করতে দেখা যায় না। যেমন হাতি হত্যা করলে আইনে ২ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে ৩ লাখ টাকা, আহত হলে ১ লাখ টাকা এবং ফসলের ক্ষতি হলে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। তবে এ আইনসহ বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত অন্য আইন প্রয়োগ হতে খুব একটা দেখা যায় না। উল্টো বন্যপ্রাণী নিধন অব্যাহত রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন যেমন অপরিহার্য, তেমনি বন্যপ্রাণীও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটিকেই সংরক্ষণ করতে হবে। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতির অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে সেখানে তাদের খাবারের পর্যাপ্ত সংস্থান করতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে সহায়তা লাভের চেষ্টা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন