শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ওষুধের নকল-ভেজাল রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, ডাক্তার ও ঔষধ। আর ওষুধই অসুস্থতার একমাত্র নিয়ামক। বর্তমানে বাংলাদেশে ঔষধ শিল্প অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো সময় পার করছে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করতে সমর্থ। সূত্র মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭টি কারখানায় প্রায় ২৪,০০০ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ঔষধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। এতে করে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষধের চাহিদা পূরণ করছে। তাছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে।

এত সব সুখবরের মধ্যে খারাপ খবর হচ্ছে, দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে প্রচুর ভেজাল ও নকল ওষুধ, যার ফলে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ঔষধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ফলে ভেজাল ও নকল ওষুধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনিসংকেত।

দিন দিন বেড়েই চলেছে নকল ও ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা। একই সঙ্গে বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ ডাক্তারের ফি ও টেস্টের (রোগ নির্ণয়) খরচের আতঙ্কে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান কম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সরাসরি চলে যান ওষুধের দোকানে। দোকান থেকে রোগের বিবরণ দিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে এসে খাচ্ছেন অহরহ। শুধু তাই নয়, কেনার সময়েও খোঁজেন কম দামি ওষুধ। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা। যখন ওষুধ সেবন করা হয়, তখন বোঝার উপায় থাকে না ওষুধটি নকল নাকি আসল। ফলে দেশের আনাচেকানাচে গড়ে উঠেছে বহু সংখ্যক লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান।

অবশ্য ক্লিনিক-হাসপাতালই যেখানে বিনা লাইসেন্সে চলছে, সেখানে ওষুধ দোকানের লাইসেন্স না থাকলে কি-ই বা যায় আসে, এমন একটা ভাব ভর করেছে কারো কারো মাঝে। করোনার মোক্ষম মৌসুম দৃষ্টে রাতারাতি শহর-বন্দর- জনপদের আনাচে-কানাচে গজিয়েছে বহু ফার্মেসি। করোনাকালে বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা কয়েকগুণ বাড়ায় এসব দোকানের ব্যবসা বেশ জমেছে। নকল, ভেজাল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও নিমিষে চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে দেদার।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিবন্ধনহীন ফার্মেসির সংখ্যা দেড় লাখ বলে প্রচারিত। আবার বৈধ দোকানের সংখ্যাও এমনই। সংখ্যা যা-ই হোক, বিশাল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফার্মেসি খুলতে কিছু নিয়ম রয়েছে। পাইকারি-খুচরা দুই ধরনের লাইসেন্স রয়েছে। তা ড্রাগ লাইসেন্স নামেই বেশি পরিচিত। খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরিতে এ লাইসেন্স দেয় অধিদপ্তর। একটি মডেল ফার্মেসির, আরেকটি মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয় ৩০০ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভেতরে হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাইরে হলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে দিতে হয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এর বাইরে আরো কিছু নিয়ম রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি, মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মালিকের ব্যাংক সচ্ছলতার সনদ, ফার্মেসিতে নিয়োজিত গ্র্যাজুয়েট বা এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারনামা, দোকান ভাড়ার চুক্তিনামা ইত্যাদি

করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ঢাকাসহ সারা দেশের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে নতুন অসংখ্য ওষুধের দোকান। এগুলোর বেশির ভাগই অবৈধ। কিছু বৈধও আছে। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ভাগেযোগে করলে লাইসেন্স পেতে বেশি সমস্যা হয় না। সেখানকার লোকেরাই কন্ট্রাক্টে কাগজপত্র সব তৈরি করে দেয়। বেকার-আধাবেকার অনেকেই ঝুঁকেছে এ ব্যবসায়। মুদি দোকানদার, সেলুন বা লন্ড্রি মালিকরাও ওষুধের সাইড বিজনেস খুলে বসেছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতি ব্যবসায়িক মনোভাব এবং জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে ফার্মেসিগুলো বেশ চলছে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশে দেশের সব জেলার ড্রাগ সুপার, সিভিল সার্জন, উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার ওষুধের দোকানের তথ্য জানাতে বলা হয়েছিল। এর কোনো ফলোআপ তথ্য নেই।

একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেয়ার পর প্রতি দুই বছর অন্তর নবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না অনেক ব্যবসায়ী। এতে সমস্যা হচ্ছে না। যেখানে লাইসেন্সই লাগছে না, সেখানে তাদের মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের গরজই হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে খাদ্যের মত মানুষের ওষুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইচ্ছা করলেই যে কেউ ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করতে পারবেন না। ওষুধ তিনিই বিক্রি করতে পারবেন, যার ফার্মাসিস্ট ট্রেনিং এবং ড্রাগ লাইসেন্স আছে। ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের ব্যবসা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনগতভাবে এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। আর ওষুধ ব্যবসার জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই ড্রাগ লাইসেন্সটি ইস্যু করে বাংলাদেশ সরকারের ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর’। তিনটি ক্যাটাগরিতে ড্রাগ লাইসেন্সের রেজিস্ট্রেশন হয়। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ‘এ’ ক্যাটাগরির, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টরা ‘বি’ ক্যাটাগরির ও শর্ট কোর্স সম্পন্নকারীরা ‘সি’ ক্যাটাগরির লাইসেন্স পেয়ে থাকেন। ‘বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল’ থেকে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট হিসেবে ড্রাগ লাইসেন্স অর্জন করতে হলে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির তত্ত্বাবধানে দুই মাসের ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। বাংলাদেশের সব জেলায় কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির আওতায় দুই মাসের শর্ট কোর্সটি করানো হয়। এ সমিতির প্রধান কার্যালয় ঢাকার মিটফোর্ডে। এসএসসি পাস করে যে কেউ এ কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। সর্বমোট ৪০টি ক্লাস করানো হয়।

পুরনো ফার্মেসি মালিকদের অনেকেই মুনাফার কারসাজিতে অভিজ্ঞ। সে কারণে সাধারণ মানুষের ‘পকেট কাটার’ নানা কৌশল অবলম্বন করে লাভও করতে পারছেন বেশি। অন্যদিকে, লোকসানের কারণে ওষুধের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এমন নজির খুব কম। ওষুধ প্রশাসনের কার্যকর তদারকির অভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে লাইসেন্স ছাড়াই গড়ে উঠেছে ফার্মেসি। ওষুধ বিক্রির পর টাকা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেকটা অল্প পুঁজিতেও ব্যবসা করতে পারছে ফার্মেসিগুলো। ভোক্তাদের প্রয়োজন আর চাহিদা বুঝে ফার্মেসি মালিকদের অনেকে প্রায় নিয়মিতই ওষুধের অযৌক্তিক দাম আদায় করছেন। বিশেষ করে মৌসুমি অসুখ-বিসুখে যেসব ওষুধের চাহিদা বেশি সেগুলোর দাম দোকানে দোকানে তারতম্য হয়। হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ জটিল শারীরিক সমস্যায় ব্যবহৃত বিদেশি উচ্চমূল্যের ওষুধের দাম রাখা হয় যথেচ্ছ হারে। কোনো কোনো ওষুধের দাম আমদানি মূল্যের তিন-চারগুণ। শুষ্ক মৌসুমে অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে গেলে ইনহেলারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দাম রাখা হয়।

এদিকে কোম্পানিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ওষুধ বিপণন এখন ‘মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ’ নির্ভর হয়ে পড়েছে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা দোকানিকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে নিজেদের ওষুধ বাজারজাত করতে তৎপর থাকে। ফলে বাকিতে ওষুধ রেখে বিক্রি করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। এ জন্য কম পুঁজিতেও ওষুধের ব্যবসা জমিয়ে তোলা যায়। এর বাইরে স্যাম্পল ওষুধের ব্যবসাও চলছে। উৎপাদনকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের বিনামূল্যে দেওয়া এসব ওষুধ কেনাবেচা নিষিদ্ধ। কিন্তু চিকিৎসকরা টাকার বিনিময়ে এসব ওষুধ ফার্মেসিতে বিক্রি করে দেন।

বিশ্বের কিছু দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। পাকিস্তান, ভারত, ল্যাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। করোনায় নানা ওষুধের চাহিদা বুঝে তা আরো বেড়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনী হাতে গোনা কিছু ওষুধ বিক্রেতা ও কিছু প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে জরিমানা করে ছেড়ে দিচ্ছে, আবার কিছু মামলাও হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। ভেজাল, নকল ওষুধের ব্যাপারে সরকারের আরো সজাগ হবার দরকার রয়েছে। পাশাপাশি সচেতন হতে হবে মানুষকেও। চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্ট বা ওষুধ আইন বলবৎ আছে। এ আইনের আওতায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তা খুবই নগন্য। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম যে, তাতে অপরাধ ও অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন