এসএসসি, এইচএসসি ও ভর্তি পরীক্ষাসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। আগে যেটা কল্পনাও করা যেতো না, সেটা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়িছে। ইদানিং সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। গত বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রায়াত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকা নিখিল রঞ্জন ধরের নাম আসে পুলিশের তদন্তে। এরপর বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এইসঙ্গে তাকে কোনো পরীক্ষার দায়িত্ব পালন না করার নির্দেশ দেয়া হয়। নিয়োগ পরীক্ষার অপর এক ঘটনায় দুই ব্যাংক কর্মকর্তা ও দুদকের এক সাবেক কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে গত বছর ৬ কোটি টাকা পায় ডিবি। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন চক্র সক্রিয় আছে বলে জানা যায়। এরকম একটি চক্রের ১০ জন সদস্যকে গত শুক্রবার আটক করেছে ডিবি। এদের মধ্যে একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী এবং বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিনও রয়েছেন। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়ের বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান। গত শুক্রবার বিকালে ছিল অডিটর নিয়োগের পরীক্ষা। পরীক্ষায় অংশ নেন মাহবুবা নাসরিন। তাকে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজে ব্যবহারযোগ্য ডিভাইসসহ গ্রেফতার করে ডিবি। ডিবি সূত্র মতে, পরীক্ষার্থী হিসাবে কেন্দ্রে হাজির থেকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে টাকা নেয়া চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্নের উত্তর লিখতে মাহবুবা নাসরিন সহায়তা করতেন। এর আগে রেলওয়েসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে তার জড়িত থাকার অভিযোগ বা তথ্য রয়েছে। মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার কথা বলে ১৬ লাখ টাকা চুক্তি করতো। ২ থেকে ৫ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে নেয়া হতো।
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যে ইতোমধ্যেই অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসায়ে পরণিত হয়েছে, বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র গড়ে ওঠা ও চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের মোটা অংকের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনা সেটা যেমন প্রমাণ করে, তেমনি জনপ্রতিনিধিদের এই চক্রভুক্ত হওয়ার ঘটনাও প্রমাণ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন জনপ্রতিনিধি কীভাবে এই অন্যায় ও অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়? তার তো জনপ্রতিনিধি হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকার কথা। অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে টাকা হাতানো জনপ্রতিনিধির কাজ হতে পারে না। বিনাভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, পুলিশ ও প্রশাসনের বদান্যে এবং সন্ত্রাস ও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া আমাদের দেশে রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে। সরকারি দল ছাড়া দেশে এখন কার্যত কোনো দল নেই। ‘নির্বাচিত’ জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাই সরকারি দলের। সরকারি দলের প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী, পেশীশক্তির অধিকারীরাই জনপ্রতিনিধির মনোনয়ন লাভ করেন। আর মনোনয়ন মানেই হলো নির্বাচিত হওয়া। চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি টোলবাজি, টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য সরকারি দলের লোকদের যেন একচেটিয়া অধিকার। এমতাবস্থায়, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরকারি দলের লোক, সরকারি দলের সমর্থক এবং এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও যদি জড়িত হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হলে বিরাজমান অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, কোনো কিছুই সহজে পাওয়ার উপায় নেই। পেতে হলে দিতে হবে। চাকরি, সেবা, ব্যবসা, ঋণ ইত্যাদি কোনো কিছুই আগাম ও বাড়তি কিছু দেয়া ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। একজন সরকারি চাকরি প্রার্থী, যিনি নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করতে বা চাকরি পেতে বড় অংকের অর্থ দিয়েছেন, তিনি চাকরিতে ঢুকে কী করবেন? উৎকোচ বা ঘুষ ছাড়া কি কোনো কাজ করবেন? করবেন না। এখন এমন কোনো সরকারি অফিস নেই, সেবা প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে কোনো কাজ বা সেবা বিনা ঘুষে বা তথাকথিত স্পিডমানি ছাড়া হয়। কাজের মান নিয়েও প্রশ্নের অবধি নেই। পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিদেশি প্রতিপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি, নির্মাণ কাজ সম্পাদন ও তদারকি ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর অন্যতম কারণ উপযুক্ত লোক নিয়োগে ব্যর্থতা।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতরে, বিভাগে, প্রতিষ্ঠানে, প্রকল্পে, বাহিনীতে যারা কাজ করেন, তাদের একাংশ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, অপরাংশ কর্মী হিসেবে যুক্ত। সরকারের জনবল বলতে তারাই। তারা যদি স্বস্ব ক্ষেত্রে শিক্ষায়, দিক্ষায়, যোগ্যতায়, অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায় ঋদ্ধ না হন, সৎ ও স্বচ্ছ না হন, তাহলে সরকারের কাজ ভালোভাবে, সুচারুরূপে, সফলতার সঙ্গে সম্পাদিত হবে না। এজন্য সর্বাগ্রে নজর দেয়া উচিৎ নিয়োগে। নিয়োগ দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। পিএসসিসহ সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছ হতে হবে। শিক্ষা ও সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা জালিয়াতি যে কোনো মূল্যে রোধ করতে হবে। পরীক্ষার মূল কথা যাচাই। কে কতটুকু উপযুক্ত তা নির্ণয় করাই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। কাজেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এবং সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কোনো চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস না করতে পারে। নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা এজন্যই আনতে হবে, যাতে বিভিন্ন পদ ও অবস্থানে উপযুক্ত ব্যক্তিদের অধিষ্ঠান নিশ্চিত হয়। আলোচ্য প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রকে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সকল ঘটনার তদন্ত, দ্রুতায়িত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন