এক বছর আগেও রংপুর মেডিক্যাল কলেজে পদোন্নতিবিহীন ১৭ বছর। একই পদে থাকা স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, বেতনের টাকাটা না হলে বেঁচে থাকা কঠিন, তাই কষ্ট চেপে চাকরি করি। তা না হলে কবে চাকরি ছেড়ে দিতাম! অনেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি নিয়ে, কেউ কেউ পদোন্নতি ছাড়াই স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদানকৃত পদ থেকে অবসরে যান। এ ছিল স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসকদের নিয়তি। তবে স্বাস্থ্য খাতে এখন আর সে অবস্থার অবকাশ নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো গ্রেডের চিকিৎসকের পদোন্নতি ও পদায়ন হচ্ছে।
গত ২৪ নভেম্বর একদিনেই ২ হাজার ১৯৫ জন চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে নিয়োগ পাওয়া এ চিকিৎসকরা এতোদিন পদন্নোতি বঞ্চিত ছিলেন। এদের মধ্যে ১৯৫৮ জন নবম গ্রেড থেকে সপ্তম গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া ১৮৩ জন ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম গ্রেডে, ৫৪ জন পঞ্চম থেকে চতুর্থ গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছেন। এরই মধ্যে সহকারী পরিচালক পদ থেকে উপ-পরিচালক পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়েছে। ৮৪টি সাবজেক্টের চিকিৎসকদের মধ্যে সুপরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে প্রফেসর করা হয়েছে। এছাড়া ১৯২ জনকে ৫ম গ্রেডে সহকারী পরিচালক পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে যেসব চিকিৎসকরা গ্রেড পাচ্ছিল না, তাদের মধ্যে ২ হাজার ৭শ’ জনকে এরই মধ্যে গ্রেড দেয়া হয়েছে। অনেকে অবসরে গেছেন তাদের পরিবারও এ সুবিধা ভোগ করবে। অবশ্য স্বাস্থ্য খাতে শুধু পদোন্নতিই নয়; তৃণমূলে ৫০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পদায়ন করা হচ্ছে। যাদের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হবে। এসব চিকিৎসকরা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জরুরি সেবার পাশাপাশি মহামারি করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে।
এছাড়াও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ১৫৫টি বিষয়ে ৪ হাজার ২শ’ আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। ডিপিসি’র মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রয়াসে পদোন্নতি প্রক্রিয়া চলমান। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রেড পাচ্ছিল না, তাদের ভূতাপেক্ষভাবে গ্রেড প্রদান কার্যক্রম চলমান আছে।
পদোন্নতি, পদায়ন, রদবদলসহ নানামুখী কার্যক্রমে দীর্ঘদিনের অস্থিরতা কাটিয়ে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে। দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে। এর আগে এসব কার্যক্রম করোনা নিয়ন্ত্রণে আরও সাফল্য পেতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে স্বাস্থ্য খাতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, অসঙ্গতি রয়েছে বা চলছে তা দূর করতে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) ব্যাপক রদবদল করতে হবে। একইসঙ্গে চিকিৎসক ও আমলাদের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে তা দূর করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে এখনও চিকিৎসক এবং আমলা দ্বন্দ্ব বিরাজমান। শৃঙ্খলায় আসতে সবার মধ্যে কাজের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. নন্দলাল সূত্রধর বলেন, অনেক বছর ধরে আমরা পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আসছিলাম। পদোন্নতি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খুরশীদ আলম, পরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর ডা. মো. শামিউল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। পদোন্নতি পাওয়াদের সঙ্গে কথা বললে তাদের মধ্যে ঈদ আনন্দের মতো অবস্থা বিরাজ করছে।
সূত্রমতে, করোনা মহামারি শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে উঠে এলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নির্দেশনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা ফেরাতে ব্যাপক রদবদলসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সরিয়ে দেয়া হয় প্রথমে সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামকে। বিতর্কের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ। একই সঙ্গে ওই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবসহ কয়েকজনকে বদলি করা হয়। এছাড়া সরিয়ে দেয়া হয় ওই সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিতর্কিত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. আমিনুল হাসানকে। পরে সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের স্থানে আসা আব্দুল মান্নানকেও নানামুখী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সরিয়ে দেয়া হয়।
সূত্রমতে, স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর মূল দায়িত্বে থাকেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসন। এই পদে এতদিন যারা আসীন হয়েছেন, তাদের নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ছিল বিতর্ক। আর এ কারণে এ পদে স্থায়ী হতে পারেননি পরিচালকরা। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ জনকে পরিচালক প্রশাসন পদে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
অথচ গত ৩ নভেম্বর দায়িত্ব নিয়েই স্বাস্থ্য মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের পরামর্শে পরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর ডা. মো. শামিউল ইসলাম চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসানে ব্যবস্থা নেন। প্রতিদিনই স্বাস্থ্য খাতকে গতিশীল করতে কার্যকরি পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
পরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর ডা. মো. শামিউল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, করোনাকালীন স্বাস্থ্যকর্মীদের চাঙা রাখতে ও শৃঙ্খলা ফেরাতে পদোন্নতি ও পদায়ন চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, কর্মচারীদের মধ্যে সিনিয়র টেকনোলজিস্ট পদোন্নতি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদোন্নতি, উচ্চমান সহকারী পদোন্নতি ও স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এ বিএম খুরশীদ আলম ইনকিলাবকে বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরামর্শে অধিদফতরে শৃঙ্খলা ফেরাতে সর্বোচ্চ কাজ করছি। তবে স্বাস্থ্য খাত তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরোপুরি শৃঙ্খলায় আনতে আরও সময় লাগবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. আবদুল হামিদ বলেন, উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত অবস্থানে না বসালে শৃঙ্খলা ফিরবে না। তিনি বলেন, প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত লোক বসাতে হবে। এক্ষেত্রে হেলথ ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা জরুরি। অর্থাৎ জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো করে হেলথ ক্যাডার সার্ভিস গঠন করতে হবে। পাশাপাশি সর্বস্তরে যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন