জাতীয় বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের সর্বোচ্চ ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। দেশি-বিদেশি ঋণের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বৈদেশিক ঋণের টাকায় গৃহিত কোনো কোনো প্রকল্প ব্যয়ের বড় অংশই চলে যায় তথাকথিত পরামর্শকদের পেছনে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যথার্থভাবেই এ ধরণের বাস্তবতাকে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় ট্রান্সপোর্ট সমন্বয়ক কর্তৃপক্ষ(ডিটিসিএ)’র ৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আরো অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক খাতে এ ধরণের অস্বাভাবিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে যে সব শর্তের বেড়াজাল থাকে তার অন্যতম হচ্ছে, তাদের বেঁধে দেয়া প্রতিষ্ঠান ও শর্তসাপেক্ষে পরামর্শক নিয়োগ করা। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা পরামর্শক খাতে ঋণদাতাদের কাছে ফেরত গেলেও ঋণের দায় ঠিকই দেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পরামর্শক নিয়োগে প্রকল্প ব্যয়ের বেশিরভাগ অর্থ খরচের মধ্য দিয়েই বেড়ে চলেছে বৈদেশিক ঋণের দায়-দেনার আকার। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, চায়না এক্সিম ব্যাংক, এআইআইবি, এইচএসবিসিসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবানাধীন সাম্প্রতিক সময়ের ২১ প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা পরামর্শক খাতে ব্যয়ের তথ্য জানা যায়।
প্রবাসি শ্রমিকদের রেমিটেন্স এবং গার্মেন্ট রফতানি খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে বাংলাদেশ ঋণগ্রহিতা থেকে ঋণদাতা হিসেবেও নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য শর্তে বৈদেশিক ঋণে প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা বন্ধ হয়নি। খরচ ও লক্ষ্য অনুসারে বিদেশি ঋণ ও সহায়তা নির্ভর কোনো প্রকল্পেরই বাস্তব সুফল পাওয়া যায়নি। আজকে যেমন উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের অস্বাভাবিক খরচের বির্তক উঠছে, ঠিক একইভাবে এক দশক আগেও অনুরূপ চিত্র ও বিতর্ক দেখা গেছে। ২০১২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মর্ডানাইজেশন, অটোমেশন এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত ২৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের ৮৩ শতাংশই ব্যয় হয়েছে পরামর্শক নিয়োগ ও কেনাকাটায়। একই সময়ে রাজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর নামে গৃহিত অনুরূপ আরেকটি প্রকল্পের অধীনে অন্তত ১০০ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণে বিপুল ব্যয়ের তথ্য জানা যায়। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল শেষে খোদ জাতীয় রাজস্ববোর্ডের মূল্যায়নেই এ সব প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধুমাত্র জাতীয় রাজস্ববোর্ডের কাজের দক্ষতা, স্বচ্ছতা,গতিশীলতা ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে গৃহিত প্রকল্পগুলোর সিংহভাগই পরামর্শক, কেনাকাটা ও বিদেশ ভ্রমণের নামে লুটপাট হয়েছে। এর ফলে রাজস্ববোর্ড কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। মূলত দেশি-বিদেশি আমলাতান্ত্রিক ভাগবাটোয়ারার যোগসাজশেই এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে বলে প্রতিয়মান হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কেনাকাটায় উচ্চমাত্রার দুর্নীতির মাইলফলক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পের আবাসিক খাতে বালিশ কেনা বা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনায় পুকুর চুরিরমত ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর গণমাধ্যমেও শিরোনাম হতে দেখা গেছে। তবে অবস্থার যে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি তা ডিটিসিএ’র চলমান প্রকল্পের ৩৪ কোটি টাকার ২৫ কোটি টাকা পরামর্শক নিয়োগ খাতে ব্যয় দেখানোর মধ্য দিয়ে আবারো প্রমানিত হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে প্রকল্প বার বার সংশোধনের নামে সময়ক্ষেপন ও ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়ে একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তি প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়লে পরামর্শকদের ব্যয়ও বেড়ে যায়। পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যে উন্নয়ন সহযোগীদের শর্ত ও চাহিদার বেড়াজালের প্রসঙ্গ খোলামেলাভাবেই উঠে এসেছে। দেশ এখন আর অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল নয়। এখনো কেন, কার স্বার্থে বরাদ্দের আশিভাগ অর্থ তাদের পরামর্শকদের হাতে তুলে দেয়ার শর্ত মেনে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়? পুকুর খনন প্রকল্পের জন্য বা স্কুল ফিডিং প্রকল্পে খিচুরি রান্না ও পরিবেশন কার্যক্রম দেখার নামে কর্মকর্তারা দলবেধে বিদেশ ভ্রমণ করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করার পেছনে দেশি-বিদেশি আমলাতান্ত্রিক লুটপাটের অভিন্ন চিত্রই দেখা যায়। বার বার সংশোধন ও সময়ক্ষেপনের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে অহেতুক বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির নামে দুর্নীতির চিত্র পাল্টাতে না পারলে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প জনগণের উপর ঋণের বোঝা বাড়ালেও এসব প্রকল্পের বাস্তব সুফল থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। নিজস্ব বাস্তবতায় নিজেদের অর্থে ও নিজেদের বিশেষজ্ঞ ও ফিজিবিলিটি রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাস্তব চাহিদা ও সম্ভাবনাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যের চাপিয়ে দেয়া শর্তে ঋণগ্রহণ, পরামর্শক নিয়োগ ও বিদেশ ভ্রমণের নামে জনগণের অর্থ লোপাট বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন