গলার সামনের অংশের গ্রন্থিটাকে থাইরয়েড গ্রন্থি বা গ্লান্ড বলে। এই থাইরয়েড গ্রন্থিতে কখনও কখনও টিউমার হতে পারে। যেটাকে নডিউলও বলা হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিনাইন বা ভাল ধরনের টিউমার অথবা সিস্ট হতে পারে। অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়। তবে ২০ জনের একজন অর্থাৎ খুব কম সময়ই এটা ক্যান্সার টিউমার পর্যন্ত হতে পারে।
থায়রয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষ সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থাইরয়েড ক্যান্সার বলে। গত তিন দশকে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঘটনা নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এখন মহিলাদের মধ্যে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার। ৩০ বছরের কাছাকাছি সময়ে আবার ৬০ বছরের বেশী বয়সিদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের প্রবনতা বেশী। পুরুষের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে এটা হওয়ার প্রবনতা ২ থেকে ৩ গুন বেশী। পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৫.৪% এবং মহিলাদের মধ্যে ক্যান্সারের ৬.৫% নির্দেশ করে। এই বৃদ্ধির প্রায় পুরোটাই প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সারের। প্রতি ১০ জনের ৮ জনই এই ধরনের ক্যান্সার নিয়ে আসছেন। ৪০ বছরের কাছাকাছি মানুষের, বিশেষকরে মহিলাদের এটি বেশী হয়। আবার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এর কারণ অস্পষ্ট। এছাড়াও ফলিকুলার কারসিনোমা, মেডুলারি থাইরয়েড কারসিনোমা ও এনাপ্লাস্টিক থাইরয়েড কারসিনোমাও কারও কারও হতে পারে। তবে প্যাপিলারি কারসিনোমা ও ফলিকুলার কারসিনোমার চিকিৎসা অনেকটাই সহজ।
থাইরয়েড ক্যান্সারে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:
গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠা বা শক্ত চাকার মত অনুভুত হওয়া। এই ফোলা খাবার গ্রহনের সময় বা ঢোগ গিলার সময় ঊঠানামা করে। ক্যান্সার হলে সেই ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়ে যায়। সাথে রুগীর ওজন কমতে থাকে।
থাইরয়েড গ্রন্থির আশেপাশে অর্থাৎ ডান বা বাম পাশে একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে; তবে কখনও কখনও উভয় পাশে টিউমার হতে পারে। আশপাশের লিম্ফ নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে।
থাইরয়েড টিউমার তার পাশের নার্ভ বা স্নায়ুকে আক্রান্ত করলে গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে।
বড় থাইরয়েড টিউমার শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টি করলে শ্বাসকষ্টও হতে পারে। দ্রুত অপসারণ না করলে তা ছড়িয়েও পরতে পারে।
এসময় খেয়াল রাখতে হবে যে নিকট বংশে থাইরয়েড ক্যান্সার এর ইতিহাস আছে কিনা। থাকলে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও এর প্রবনতা থাকতে পারে।
টিউমার বা ক্যান্সার হলে কি চিকিৎসা করবেন?
থায়রয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব। তবে অবশ্যই সময়মতো সম্পূর্ণ চিকিৎসা করাতে হবে। গলার সামনে ফুলে উঠলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞকে দেখানো উচিত। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা (আলট্রাসনোগ্রাম, থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট এবং সবচেয়ে স্পেসিফিক এফএনএসি করে দেখবেন এটা কোন ধরণের টিউমার রোগ।
গলায় থাইরয়েড ক্যান্সার শনাক্ত হলে বা ক্যান্সার আছে এমন সন্দেহ হলে অতিদ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ যারা থাইরয়েড অপারেশনে পারদর্শী কোনো সার্জনের কাছে যেতে হবে। থায়রয়েড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কার্যকরী চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন বা সার্জারি করে অতিদ্রুত টিউমারটি অপসারন করে ফেলা। পরীক্ষার পর আক্রান্তের ধরনের ওপর নির্ভর করবে থাইরয়েড গ্রন্থির কতটুকু কাটতে হবে। কখনও কখনও আংশিক বা পুরো থাইরয়েড গ্রন্থিটাই কেটে বাদ দিতে হয়। অপারেশনের পর থাইরয়েড ক্যান্সার এর প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট ডোজ এর রেডিও আয়োডিন থেরাপি নেয়া লাগতে পারে। কারও কারও এক্সটার্নাল রেডিও থেরাপি বা কেমোথেরাপি লাগতে পারে। থাইরয়েড ক্যান্সার এর রোগীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে অপারেশনের পর আপনার চিকিৎসকের অধীনে সারা জীবন ফলোআপে থাকতে হবে। কারন কারও কারও ক্ষেত্রে এটা ফিরে আসতে পারে, যদিও এটা খুবই কম।
আবারও বলি সময়মত চিকিৎসা শুরু করলে রুগী পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে পারে। তবে এই যুগেও, এখনও অনেকেই ঝার-ফুক, হোমিও, কবিরাজির কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করে শেষ সময়ে সার্জনের কাছে আসছেন, যা মোটেই কাম্য নয়।
আতংকিত না হয়ে সচেতন হই। ভালো থাকি-ভালো রাখি।
ডাঃ মোঃ আব্দুল হাফিজ শাফী
নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, রেজিস্ট্রার, সিওমেক হাসপাতাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন