শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপপ্রয়াস রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এক হিন্দু যুবক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ইসলাম অবমাননাকর পোস্ট দেয়ার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে উত্তেজনা, হিন্দু মন্দির ও বাড়ি-ঘরে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলা এবং ভাঙচুরের দুঃখজনক ঘটনায় আমরা ব্যথিত ও বিস্মিত। এই ঘটনাকে দেশে বিদ্যমান স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে কোনো মহলের পরিকল্পিত উস্কানি ও ষড়যন্ত্র বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। হিন্দু যুবক রসরাজ দাস কাবাঘরের ছবির উপর শিবলিঙ্গ সংযুক্ত করে যে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছে তার সূত্র ধরেই স্থানীয় মুসলমানরা প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, কিছু মানুষ উক্ত হিন্দু যুবকের শাস্তি দাবির পাশাপাশি তাকে ধরে পুলিশেও সোপর্দ করেছে। তবে হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষের মধ্য থেকে কে বা কারা হিন্দু মন্দিরে এবং হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। যারা এ কাজ করেছে তারা নিঃসন্দেহে শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষের লোক নয়। অসৎ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও দাঙ্গা সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানী একটি শ্রেণির অপচেষ্টা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ও অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ইতিমধ্যেই নাসিরনগরের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। ৫ শতাধিক লোককে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে উল্লেখ করে দু’টি মামলা দায়েরের পর ইতিমধ্যে পুলিশ অন্তত ৯ জনকে আটক করেছে বলে জানা যায়।
সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বছরে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মানুষ হতাহত হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় সদা সচেষ্ট। তবে পর্দার অন্তরালে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অপশক্তি সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তারা বিভিন্ন সময়ে কৃত্রিম ইস্যু সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে এটা প্রমাণ করতে চায় যে, বাংলাদেশে হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণ ও প্রতিহিংসার শিকার। দেশি-বিদেশি মিডিয়াগুলো এ ধরনের খবরের ফলাও প্রচার চালানোর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য ও ইমেজ নষ্ট হয়। যদিও এটি বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র নয়। হিন্দুদের উপর নির্যাতন ও হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনায় কোনো কোনো মহলের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের উপর দোষ চাপানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। হিন্দু মন্দিরে হামলা চালানোর সময় স্থানীয় জনতার হাতে হিন্দু যুবক ধরা পড়ার ঘটনাও খুব বিরল নয়। নাসিরনগরের ঘটনা নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক তখন ঢাকার গাজীপুরে কতিপয় যুবক ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুরের চেষ্টাকালে মন্দিরের পুরোহিত এবং স্থানীয়দের হাতে একজন ধরা পড়ে যায়। গতকাল একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, উক্ত যুবকের নাম সঞ্জয় সাহা (২৮), পিতার নাম গণেশ সাহা, তারা টঙ্গির জামাই বাজারের জনৈক সফিকুলের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। পুলিশের হাতে আটক উক্ত হিন্দু যুবকের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশে তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। বিশেষত: নাসিরনগরে ইসলাম অবমাননাকর ফেসবুক পোস্ট এবং হিন্দু মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার সাথে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের পুলিশ খুঁজে বের করে বিচারের সোপর্দ করতে সক্ষম হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সম্প্রতি সাড়ম্বরে সারাদেশে হাজার হাজার পূজাম-পে পালিত হলো দুর্র্গাপূজা ও বিসর্জন। দেশের কোথাও উল্লেখ করার মতো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। যেখানে দুর্গাপূজা, আশুরা এবং ঈদ একই সাথে পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। অপশক্তির নাশকতার আশঙ্কায় মুসলমান যুবকদের হিন্দু মন্দিরে পাহারা দেয়ার উদাহরণও আছে। সেখানে ইসলামের পবিত্র কাবাঘরের বিকৃতিমূলক আপত্তিকর ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং তা কেন্দ্র করে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্টের উদ্দেশ্যমূলক অপচেষ্টা সফল হতে দেয়া যায় না। ইসলাম অবমাননাকর কার্টুন ও ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের দায়ে ইউরোপে তোলপাড় সৃষ্টির ঘটনা বেশিদিন আগের কথা নয়। একটি ইসলামবিদ্বেষী চক্র মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে সারাবিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে চায়। নাসিরনগরের হিন্দু যুবকের ফেসবুকে কাবাঘর অবমাননার ঘটনাকে আমরা একই পাল্লায় মাপতে চাই না। তবে আমরা উপযুক্ত আইনগত প্রক্রিয়ায় কাবাঘরের অবমাননাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। সেই সাথে যারা এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে হিন্দু মন্দির বা হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে তাদেরও উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি। তবে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করতে হবে। বিশেষত: ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল আচরণ করতে হবে। সেই সাথে অজ্ঞাতনামা শত শত মানুষকে আসামি করে দায়ের করা মামলার সুযোগে পুলিশ যেন গণগ্রেফতার বা গ্রেফতার বাণিজ্যে লিপ্ত না হয় সেদিকে অবশ্যই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন ও নজরদারি রাখতে হবে। নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও দায় এড়াতে পারেন না। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। বাংলাদেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। সম্প্রীতি নস্যাতের ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন