শিশুর জীবনে মা ও বাবা- দু’জনেরই গুরুত্ব আছে। শিশুরা তাদের কাছ থেকে সমান যত্ন ও মনোযোগ প্রত্যাশা করে। তবে আমাদের সমাজে শিশুর লালন-পালন ও সার্বিক বিকাশে মাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। শিশুর জন্মদান থেকে শুরু করে তার লালন-পালন করা, যত্ন নেয়া, এমনকি তার লেখাপড়া ও অন্যান্য বিকাশের ক্ষেত্রে মাকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। অন্যদিকে বেশিরভাগ বাবা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে খুব কমই সম্পৃক্ত হয়। সাধারণত ধরে নেয়া হয়, বাবার দায়িত্ব অর্থ উপার্জন করা, বাজার করা, বাড়ির বাইরের অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা। ফলে, বাবার চেয়ে মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক অনেকটা গভীর। প্রথমত, প্রকৃতিগতভাবে সেই সম্পর্কটা হলো নাড়ীর, আত্মিক বা আত্মার। তাই বলা যায়, মাতৃবিয়োগ বা বিচ্ছেদ হলে শিশু জীবন সমুদ্রে ভাসমান খড়কুটার সমতুল্য হয়ে ওঠে।
শিশু জন্মের অনেক আগে থেকেই আগত সন্তানের প্রতি মায়ের মনোভাব, মা হিসেবে তার দায়িত্ব, আগ্রহ ও জ্ঞান, স্বামী ও অন্যান্য পরিজনের সাথে তার সম্পর্ক সবই শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর মা ও শিশুর সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। শিশুর প্রতি মায়ের অবহেলা ও প্রত্যাখ্যান নানান কারণে হতে পারে। যেমন, শিশুর আগমনে বাবা-মার সম্পর্কের অবনতি, অবাঞ্চিত শিশু, শিশুর আগমনে পরিবারের অর্থনৈতিক চাপ ইত্যাদি।
ভবিষ্যতে শিশুর মন-মেজাজ কেমন হবে তা অনেক সময় মা ও শিশুর সম্পর্কের ধরন দিয়ে নির্ধারিত হয়। যেমন, কিছু কিছু শিশু জন্ম থেকেই দৃঢ় মনোভাবসম্পন্ন হয়, আবার কিছু কিছু শিশু বেশি নমনীয় হয়, তাদের সহজেই বশে আনা যায়। সাধারণত সন্তানেরা যদি একটু চঞ্চল প্রকৃতির হয়, তাহলে তাদের জন্য মা একটু বেশি উদ্বিগ্ন থাকে। যেহেতু বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মা ও শিশু মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও পরিতৃপ্তি আসে, সেহেতু মনোবিজ্ঞানীরা শিশুর মানসিক প্রশান্তির জন্য মায়ের দুধ পান করানোকে আদর্শ বলে দাবি করেন।
৪/৫ মাস বয়স থেকেই শিশু তার মায়ের চেহারার একটা মোটামুটি ধারণা করে এবং সেই সাথে শিশু তার আরাম, সুখ ইত্যাদি অনুভূতির সাথে মায়ের যোগাযোগ উপলব্ধি করে। তাই কোনো অপরিচিত স্থান বা ব্যক্তি দেখলে শিশু নিরাপত্তার অভাববোধ করে ভীত হয়। সাধারণত দেখা গেছে, মা ও শিশুর সম্পর্ক যত নিবিড় ও গভীর হয় ততই শিশু তার মা থেকে আলাদা থাকতে ভয় পায়। শিশু থেকে মায়ের অনুপস্থিতি যত বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় শিশুর মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া তত বেশি তীব্রতর হয়। শিশু বিজ্ঞানী ইড়ষিনু এরূপ পরিস্থিতিতে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেন। যেমন, প্রথম অবস্থায়, শিশু মায়ের অনুপস্থিতিতে তীব্রভাবে বিরোধিতা করে, কান্নাকাটি করে, হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে, খেতে চায় না, ঘুমাতে চায় না। দ্বিতীয় অবস্থায়, শিশু মায়ের প্রত্যাবর্তনের আশা ছেড়ে আশে-পাশের জিনিসপত্রের প্রতি মনোযোগ দেয়। তবে, শিশু অপেক্ষাকৃত শান্ত ও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে এবং এমনকি মা ফিরে আসলেও তেমন উৎফুল্ল হয় না। তৃতীয় ও সবশেষ অবস্থায়, শিশু মায়ের অনুপস্থিতিতে আশে-পাশের জিনিসপত্র নাড়া-চাড়া করে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, শিশুর মধ্যে সামাজিক আগ্রহ কমে আসে, সে অন্য শিশুর সাথে খেলাধুলা করতে চায় না। অর্থাৎ মায়ের সঙ্গ শিশুকে সামাজিক ও ব্যক্তিত্ববান হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
প্রতিষ্ঠানে প্রতিপালিত এবং পরিত্যক্ত শিশুর মধ্যে বিমর্ষতা, উদ্দীপনার অভাব এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা যায়। জযরহবমড়ষফ এই জাতীয় শিশুদের অন্যত্র স্ন্নেহ ও উদ্দীপনাপূর্ণ পরিবেশে লালন করে তাদের মধ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ও উন্নতি লক্ষ করেছিলেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড শিশুর প্রতি মায়ের স্নেহ-মমতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, অবহেলা এবং স্নেহপূর্ণ পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নতায় শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। মনোবিজ্ঞানী এরিকসন বলেন, শিশুর মৌলিক বিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য তাকে শর্তহীন ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করতে হবে। শিশুকালে মায়ের প্রভাব আংশিকভাবে বঞ্চিত শিশুর মধ্যে এক ধরনের বিমর্ষতা দেখা যায়, যাকে ধহধপষরঃরপ ফবঢ়ৎবংংরড়হ বলে। এতে শিশুর ব্যক্তিত্বসহ সার্বিক বৃদ্ধি তীব্রভাবে ব্যাহত হয়।
কফম্যান এবং রোসেনব্লুম, ৪টি বানর ছানাকে ৪ সপ্তাহের জন্য তাদের মা বানর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। পৃথক অবস্থায় প্রথম কিছু দিন ছানাগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে এবং তারপর তারা নিস্তেজ ও উদ্দীপনাহীন হয়ে পড়ে। যখন তাদের মা বানরের কাছে ফেরত দেয়া হয়, তখন তারা আবার হারানোর ভয়ে সব সময়ই মাকে আঁকড়িয়ে রাখে।
শিশু জন্মের পর প্রথম এক বছর সব কিছুর জন্য তার মায়ের উপরই নির্ভর করে। সে কারণে শিশুর প্রতি মায়ের আগ্রহ, আদর-যত্ন, মনোভাব মায়ের প্রতি শিশুর ধারণাকে প্রভাবিত করে। মা অসহায় শিশুকে আদর-যত্নের মাধ্যমে পরিবারের পরিজনদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলেন। শিশু ও মায়ের মধ্যে স্নায়ুবিক সম্পর্ক যেমন দুধ খাওয়ানো, বুকে জড়িয়ে ধরা, আদর করা ইত্যাদি শিশুর মধ্যে সংবেদনের সূচনা হয় এবং মা ও শিশুর মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ঝুনরষষব ঊংপধষড়হধ পরীক্ষা ও গবেষণা করে দেখেছেন, মায়ের মানসিক অবস্থা শিশুকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেমন, উদ্বিগ্ন প্রকৃতির মায়ের সন্তানেরা অশান্ত মেজাজের হয় এবং শান্ত, ধীরস্থির ও সুখী প্রকৃতির মায়ের সাহচর্যে শিশু শান্ত ও সুখী হয়। মায়ের স্নেহের অভাব ও শীতলতা শিশুর মধ্যে খাবারের সমস্যা, বিছানা ভিজানো মানসিক বিকার ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। প্রশ্রাব-পায়খানায় দুর্ঘটনা বা অন্যান্য অসাবধানতায় যে সব মায়েরা তাদের সন্তানকে কঠোরভাবে শাস্তি দেন, সে সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্নায়ুবিক দুর্বলতা, বিছানা ভিজানো এবং নির্ভরশীলতা বেশি দেখা যায়। শিশুর আগ্রাসনকে কঠোরভাবে দমন করলে তাদের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব আরো বৃদ্ধি পায়। কড়া প্রকৃতির মায়েরা সাধারণত শিশুর খাওয়া-দাওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করেন। এসব শিশু পরবর্তী জীবনে অসহিষ্ণু ও খিটখিটে স্বভাবের হয়। অর্থাৎ মায়ের মানসিকতা ও মানসিক অবস্থার কারণে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিভিন্নভাবে গড়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঝশববষং ও তাঁর সহকর্মীরা বঞ্চিত শিশুর উপর পর্যালোচনা করে দেখেন যে, মা থেকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন শিশুর মধ্যে অপুষ্টি, অরুচি, বিমর্ষতা প্রভৃতি দেখা দেয়। প্রতিষ্ঠানে পালিত শিশুর মধ্যে এমন অনেক সমস্যা ও অসঙ্গতি দেখা যায়, যা কিনা পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুর মধ্যেও কদাচিৎ দেখা যায়। বিভিন্ন সমাজকর্মী ও মনোবিজ্ঞানীদের জরিপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠানে পালিত শিশু অসামাজিক হয়, অন্য শিশু বা ব্যক্তির উপস্থিতিতে নিজেকে গুটিয়ে রাখে এবং ভাষার দখল তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে। কারণ, মা ও শিশুর মধ্যে কথায় যোগাযোগ স্থাপন শিশুর ভাষার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
মা ও শিশুর মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্কের ফলে শিশু যে অভিজ্ঞতা লাভ করে, পরিবারের বাইরে বেড়ে ওঠা শিশুরা সে সব অভিজ্ঞতা হতে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে সামাজিকতা যেমন, অন্যকে দেখে হাসা, মুখের ভাব পরিবর্তন, ভাষার বিকাশ ইত্যাদি আচরণ পরস্পর সম্পর্কিত, অর্থাৎ মা শিশুর প্রতি এসব আচরণ করলে শিশুও মায়ের প্রতি তদ্রুপ করবে। তাই প্রতিষ্ঠানে পালিত শিশুর বেলাতে এই ধরনের উদ্দীপনার অভাব থাকে, যার ফলে তারা অমিশুকী এবং উদাসীন প্রকৃতির হয়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর জীবনের প্রথম তিন বছর মায়ের সম্পূর্ণ অনুপুস্থিতি শিশুকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পরে এই শিশুদের উন্নত পরিবেশে রেখেও এসব ক্ষতির পূরণ হয় না। পরিবারের বাইরে বেড়ে উঠা শিশুর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা, আগ্রাসন মনোভাব ইত্যাদি অসামাজিক আচরণ বেশি দেখা যায়। তবে এও দেখা গেছে যে, এ সব শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশে আদর-যত্ন দিলে তারাও অন্যান্য শিশুর মতো সার্বিকভাবে বিকশিত হয়, এমনকি পরিবারে মা কর্তৃক অবহেলিত শিশুর তুলনায়ও তারা অনেক কিছুতে এগিয়ে যায়। শিশুর ব্যক্তিত্বে মায়ের প্রভাব নিয়ে দু’জন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী ইধুষবু এবং ঝপযধভভবৎ গবেষণা করেছেন। তাদের প্রকাশিত তথ্য হতে দেখা গেছে, ছেলে সন্তানেরা মায়ের যত্ন ও স্নেহ-মমতায় বেশি লাভবান হয়, বেশি অনুপ্রাণিত হয় এবং মেয়ে সন্তানরা তাদের মায়ের উৎসাহ ও স্বাধীনতায় উন্নতি লাভ করে। গবেষকদ্বয় আরো লক্ষ্য করেন যে, মায়ের কঠোরতা ও দৃঢ়তা শিশুর বুদ্ধি বৃদ্ধিতে বিপরীত প্রতিক্রিয়া করে। বাবার চেয়ে মায়ের অনুমোদন, প্রশংসা ও স্বাধীনতা শিশুর সৃজনশীলতাকে বেশি প্রভাবিত করে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
shahida_taher5@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন