শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ইভিএমে ভোট হলে মানুষ হতাশ হবে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

১৯৭১ সালে দ্বিতীয় বার দেশ স্বাধীন হলো। এর পূর্বে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিলো। পাকিস্তানের অংশ ছিল বাংলাদেশ। দু’ দুবারের স্বাধীনতায় জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে নাই। বৃটিশের শাসন-শোষণের মধ্যেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল। একদল দালাল সৃষ্টির মধ্যেই বৃটিশ ভারতকে শাসন-শোষণ করত। ভারতীয় নাগরিকদের উচ্চ পদে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ হিসেবে যাদের চাকরি দেয়া হয়েছিল বৃটিশ বংশদ্ভূত রাজকর্মচারীদের চেয়ে তারা ভারতবাসীর উপর বেশি অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করার স্বপ্নদ্রষ্টা সুভাস বোস যখন কারাগারে অনশনরত ছিলেন, তখন তার অনশন ভাঙানোর জন্য বৃটিশ অফিসার ব্যর্থ হওয়ার পর এক বাঙালি অফিসার সুভাস বোসের অনশন ভাঙানোর জন্য স্বেচ্ছায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাঙালি অফিসারের অত্যাচারে সুভাস বোস অসুস্থ হয়ে শারীরিকভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে বৃটিশের আদালত সুভাস বোসকে জামিন প্রদান করেন। জামিন পেয়ে পরিকল্পিত সন্যাসী জীবন ধারণ করে আত্মগোপন করে র্জামানিতে যাওয়ার পথে প্লেন দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে কথিত আছে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের উপর যার নির্দেশে সালাম, বরকত, রফিক গংদের উপর গুলি বর্ষণ হয়েছিল তিনিও ছিলেন একজন বাঙালি, যিনি ছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার বাহাউদ্দিন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে যারা তৎকালীন সরকারের সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তারাও এদেশেরই সন্তান বাঙালি পুলিশ অফিসার। এতে এটাই প্রমাণিত যে, বাঙালি হলেই যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসিকতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে দেশবাসীর জন্য নৈতিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন, তা বিশ্বাস করার উপায় নেই। বাঙালি আমলাতন্ত্রের ট্রেডিশন সে কথা বলে না। তবে ঔপনিবেশিক আদলে গঠিত পুলিশ ও প্রশাসন তোষামোদীর যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন জেনে শুনে সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নির্দেশকেও সত্য ও সঠিক মনে করে তা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের উপরে যতটুকু খড়গ চালানো দরকার তার একটুও কম করে না। নৈতিকতা ও মানবতার স্থান আমলাতন্ত্রের অভিধানে নেই, যার শুরু ও সূচনা হয়েছিল বৃটিশ আমলে। কাগজে-কলমে বলা হয় যে, দক্ষতাই আমলাদের প্রমোশনের প্রধান উপাদান, কিন্তু সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন এবং লোভনীয় পোস্টিং তাদের ভাগ্যেই জোটে, কার্যত: যারা উপরস্থদের তৈল মর্দনে পারদর্শী। ফলে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। বর্তমান সরকার সরকার নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমলাদের অর্থাৎ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনও আজ্ঞাবহ আমলা দ্বারা গঠিত। কিন্তু আমলাদের নৈতিকতাবহির্ভূত অপরাধকে অপরাধ বলে টিকে থাকা যায় না। কারণ, আমলাতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়নকে জায়েজ করার জন্য সরকারি ‘খয়ের খাঁ’ বলে খ্যাত একদল বুদ্ধিজীবী তো তৈরি হয়ে আছে। তারাও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মতো ‘সাদা’কে ‘কালো’ বলতে এবং ‘কালো’কে ‘সাদা’ বলতে গিয়ে মাত্রা জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন।

বাংলাদেশে জাতীয়, কী স্থানীয় নির্বাচন সকলই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার হাতের মুঠোয় বন্দি। দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশন এখন ভোল পাল্টে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যার নাম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম), প্রকৃত পক্ষে এর নাম হওয়া উচিৎ ইভিল ভোটিং মেশিন। অর্থাৎ ভোট ডাকাতি করার এটা একটি বাক্স। ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের পূর্বেই সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) ইভিএম এর মাধ্যমে কীভাবে ভোটের রেজাল্ট পরিবর্তন করা যায়, তার প্রমাণাদিসহ তথ্য যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করে, যার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেলো ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। নির্বাচনে বাস্তবতার নিরিখে ভোট শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শনের পর থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়াতে ৩টি অভিযোগ করে এসেছি, যথা- (১) আঙ্গুলের ছাপ দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই ইভিএম ওপেন হয় নাই, (২) অনেক বুথে দেখেছি, মেশিন ক্রটিপূর্ণ, যা সচল হচ্ছিল না ও (৩) অনেক বুথে দেখেছি, মেশিনটি ধীর গতি হওয়ায় ভোটার টানতে পারে না। ফলে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার শেষ পর্যায়ে অনেক ভোটার কেন্দ্র থেকে চলে গেছে। ইভিএম মেশিনে কীভাবে রেজাল্ট পরিবর্তন করা যায় তা পরীক্ষাপূর্বক বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিডিয়াতে প্রকাশ করছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর নমিনেশন পেপার ক্রয় করার সময়ই বলেছিলাম, ইভিএম একটি ভোটচুরির বাক্স, যা এখন প্রমাণিত হচ্ছে যে, এটা একটি ভোট ডাকাতির বাক্স। কারণ স্বচক্ষে যা দেখেছি, তার চেয়ে বেশি বাস্তবতা এই যে, বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, ইভিএম দ্বারা ভোটের সংখ্যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা যায়। তাছাড়া ‘সিল’ সিস্টেমে ভোট হলে ‘গণনার’ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে পুনরায় গণনার একটি সুযোগ থাকে, যাতে ভুলক্রটি নিরীক্ষা করা যায়, যা ইভিএম মেশিনে ধরা পড়ে না। ফলে বাকপটু, অসত্য কথা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সরকারের কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে জয়লাভ করানোর অভিলাষ পূর্ণ করা সহজতর হয়।

নির্বাচন কমিশন পূর্ব থেকেই বলছিল এবং নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও লেভেল প্লেইং ফিল্ডকে কঠিনভাবে সুরক্ষা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, সরকারি দলের প্রার্থী অকাতরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে গেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বরং কমিশন মিডিয়ার কাছে মিথ্যাচার করে বলেছে, কোনো অভিযোগই নাকি পায়নি। অন্যদিকে কমিশনের সকল খড়গ নেমে এসেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপর। জাতীয় নির্বাচনের তফশিল আগামী বৎসরই ঘোষিত হবে। এ নির্বাচন ইভিএম-এ হবে বলেই সরকারি সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশন ষড়যন্ত্র ও ব্যর্থতার কলঙ্ক নিয়ে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই বিদায় হচ্ছে। শোনা যায়, ৭/৮ শত কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন কমিশনের জন্য সরকার ইভিএম মেশিন ক্রয় করেছে, যা ক্রয়ের বিষয়ে নৈতিক প্রক্রিয়াগত পদ্ধতি নিয়েও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ২০১৮ সালেই অভিযোগ তুলেছিলো। কিন্তু বিরোধী দলের মতামতকে সরকার বা কমিশন আমলে নেয় নাই।

ইভিএম প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্র, যারা এ পদ্ধতি চালু করেছিল, তারাও তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারপরও সরকার জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে এ মেশিনটি ক্রয় করেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের মূল শ্লোগান এখন ‘গণতন্ত্র নয় বরং উন্নয়ন’। যে উন্নয়নে সুশাসন থাকে না, সে উন্নয়ন জনগণের মন জয় করতে পারে না, ফলে সরকারের জনপ্রিয়তা ও আস্থা যে দিন দিন কমে যাচেছ, এ কথা সরকারের উপরের মহলও উপলব্ধি করতে পারছেন বিধায় জাতীয় পত্রিকায় দেখেছি যে, তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। বড় নির্বাচনগুলিতে গোয়েন্দা সংস্থার কূটকৌশল লক্ষ করা গেছে, যে কৌশল পূর্বেও ছিল। কিন্তু সময়ের শেষপ্রান্তে এসে ইতোপূর্বেও সে কৌশল শেষাবধি সব সরকারের আমলেই ভেস্তে গেছে। সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য বসে থাকে না। রাজনীতির খেলা রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য হলেও নৈতিকতা সঠিক মাত্রায় না থাকলে ক্ষমতাসীনরা যতই কূটকৌশল করুক না কেন এক সময় ব্যালেন্সশিট আর মিলাতে পারেন না এবং এটাই ইতিহাসের সাক্ষী।

সার্বিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সুশাসনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে উন্নয়নের ঢামাডোলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয় না বিধায় সরকার দিনে দিনে যখন আস্থাহীনতায় পড়তে থাকে। তখনই শুরু হয় ইভিএম-এর মতো নানা ষড়যন্ত্রের কূটকৌশল, যা নিকটতম পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের জন্য সুফল দেখা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে জাতির জন্য বয়ে আনে অশনি সংকেত। ফলে কোনো কারণেই রাজনৈতিক দলগুলি ইভিএম-এ জাতীয় নির্বাচনে যাওয়া সমীচীন হবে না, যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার এখনই সময়। সরকার অনেক লোভ-লালসা দেখাবে, দেশি-বিদেশি গোয়েন্দারা কূটচাল চালবে, কিন্তু ইভিএম-এ ভোট হলে গণমানুষ হয়ে পড়বে হতাশ। বাস্তবতার নিরিখে জাতীয় নির্বাচনের আগাম সর্তকবাণী দিয়ে গেলাম।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন