অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত এবং কোনো কোনো অংশে আট লেন করার পরও প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকছে। এমন কি মহাসড়কের মেঘনা, গোমতী ও শীতলক্ষ্যায় নতুন চার লেনের তিনটি সেতু তৈরি করার পরও যানজট কমছে না। এই মহাসড়কে যাতায়াত মসৃণ ও নির্বিঘ্ন করার জন্য সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সংস্কার করেছে এবং করছে। তারপরও যানজট কমছে না। কোনো একটি জায়গায় যানজট লাগলে তা পুরো মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা মালবাহী ও যাত্রীবাহী যানবাহনসহ অন্যান্য যানবাহন আটকে থাকছে। দুই-তিন ঘন্টার পথ অতিক্রম করতে চার-পাঁচ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। এর কারণ সম্পর্কে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহাসড়কটির কোনো কোনো অংশে অবৈধ ট্রাক ও বাস স্ট্যান্ড স্থাপন, তিন চাকার যানবাহন চলাচল এবং টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু মদনপুর চৌরাস্তায় ৮টি অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত দেশের একমাত্র আট লেনের মহাসড়ক। এরপর থেকেই চার লেন। আট লেনের সড়ক দ্রুত পার হতে পারলেও নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এর কারণ হচ্ছে, ট্রাফিক পুলিশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া-সাইনবোর্ড সড়কে চলাচলকারী যানবাহনকে সুযোগ করে দিতে হয়। এতেই মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সাইনবোর্ড ও মদনপুরে একটি করে ইউলুপ তৈরি করলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। ২০১৬ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাইনবোর্ড এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, সাইনবোর্ড, মদনপুর ও কাঁচপুরে তিনটি ইউলুপ নির্মাণ করা হবে। এই ইউলুপ আজ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি।
দেশের রফতানি বাণিজ্যের শতকরা ৮৩ ভাগ পণ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করা হয়। এক সময় অপর্যাপ্ত ও সরু সড়ক হওয়ায় যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে থাকত। মাইলের পর মাইল যানজটে আটকে পড়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চরম ভোগান্তির শিকার হতো। এক দশক আগে সরকার মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেয় এবং তা বাস্তবায়ন করে। এতে আগের তুলনায় যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকটা মসৃণ হয়। তবে সড়কের উন্নয়ন হলেও ট্রাফিক বা সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হয়নি। এখনও মহাসড়কের অনেক জায়গায় অবৈধ ট্রাক ও বাস স্ট্যান্ডসহ বাজার রয়ে গেছে। এছাড়া মহাসড়কের সাথে অন্য এলাকার সংযোগ সড়ক যুক্ত হওয়ায় তা গতিশীল থাকতে পারছে না। বিশ্বজুড়েই মহাসড়ক মানে সরল পথ। এর সাথে কোনো ধরনের সরু ও প্রশস্ত লিঙ্করোড যুক্ত হতে পারে না। যুক্ত হলেও তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মহাসড়কের চলাচল বিঘ্নিত না করে ইউলুপ, আন্ডারপাস বা অন্যকোনো ব্যবস্থা করতে হয়। অবৈধ দখল কিংবা মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের প্রশ্নই উঠে না। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে মহাসড়কের উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই, তবে তা অবৈধ দখল, বাজার, স্থাপনা নির্মাণ ও ধীরগতির যানবাহনের কারণে মহাসড়কের চরিত্র হারিয়ে ফেলছে। সম্প্রতি একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে দশ হাজারেরও বেশি অবৈধ বাজার ও অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে। মহাসড়কের এ চিত্র কল্পনাও করা যায় না। অবৈধ দখল শুধু মহাসড়কেই নয় রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারের নিচের অনেক সড়কও অবৈধ দখলে চলে গেছে। বলা বাহুল্য, এসব অবৈধ বাজার, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড ও স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে স্থানীয় ও ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। এমনকি জনপ্রতিনিধিও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একদিকে সরকার মহাসড়ক উন্নয়নে ঋণ করে ও জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, অন্যদিকে তা অবৈধ দখলকারীদের কবলে চলে যাচ্ছে। এতে মহাসড়কের বৈশিষ্ট বলতে কিছু থাকছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সৃষ্ট যানজটের কারণে ব্যবসায়ীরা নিয়মিতই ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কুমিল্লা চেম্বারস অফ কমার্সের সভাপতি বলেছেন, যানজট সবসময় না থাকলেও যখন লাগে তখন তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। এতে পরিবহন খরচ যেমন বেড়ে যায়, তেমনি কেজি প্রতি বিভিন্ন পণ্যের দাম পাঁচ থেকে ছয় টাকা বৃদ্ধি পায়।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন ও আট লেনে উন্নীত এবং ব্রিজগুলো প্রশস্ত করা হয়েছে, শুধু সড়কের অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ দখলের কারণে তা ব্যহত হচ্ছে। যানজটই যদি নিরসন না হয় এবং এর সুফল না পাওয়া যায়, তাহলে মহাসড়ককে এই চার লেন, আট লেনে উন্নীত করে কি লাভ হলো? উন্নত বিশ্বে মহাসড়ক নির্বিঘ্ন রাখতে উন্নয়নের সাথে সাথে তা রক্ষণাবেক্ষণ ও কিভাবে তা মসৃণ রাখা যায়, সেই ব্যবস্থাও করা হয়। আমাদের দেশে ঘটছে উল্টো। মহাসড়কের উন্নয়ন হলেও এর ব্যবস্থাপনার দিকে যথাযথ নজর দেয়া হয় না। আগের অবস্থায়ই থেকে যায়। সড়ক যত প্রশস্ত হচ্ছে, অবৈধ দখলদারিত্বও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মহাসড়কের পুরো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মসৃণ করতে উন্নত ও আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। এই মহাসড়ক গতিশীল রাখতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ থেকে শুরু করে যেখানে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে ইউলুপ, আন্ডারপাস ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। ধীরগতির যানবাহন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। মহাসড়কের পাশ থেকে যুক্ত হওয়া এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সড়ক বা রাস্তা বন্ধ করতে হবে। মহাসড়ক যেকোনো মূল্যে গতিশীল রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন