রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এলাকাভিত্তিক নানা রকম সামাজিক সংঘ দেখা যায়। এলাকার সমাজ হিতৈষীদের উদ্যোগে গঠিত হয় এসব সামাজিক সংঘ। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলোতে এলাকার মানুষের সম্মিলন ঘটে। এসব সামাজিক সংঘ গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক-সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি। এসব সামাজিক সংঘ পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকে। সংঘের সদস্যরা কোথাও কোথাও নির্বাচন, কোথাও কোথাও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সংঘ পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন করেন। সদস্যকরণ চাঁদা, সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা, বিত্তশালী সদস্যদের অনুদানে সংঘের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এসব সামাজিক সংঘের উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস, ঈদ উৎসব, বাংলা নববর্ষবরণ, বার্ষিক পুনর্মিলনীসহ নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায়। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলোতে এলাকার গণমান্য ব্যাক্তিবর্গ, বসবাসকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সম্মিলন ঘটে বলে এ সংঘগুলো চেষ্টা করলে এলাকার বহু সমস্যার সহজে সমাধানসহ এলাকায় শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠা সামাজিক সংঘগুলো এলাকার কী কী ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে, এলাকায় শান্তি ও আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা জানা থাকলে ভালো হয়। বর্তমানে আইন শৃঙ্খলার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে কিশোর গ্যাং। এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান রোধ, উত্থিত কিশোর গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও অধিকতর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘ। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকার বিপথগামী সন্তান। এলাকার বিপথগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা ও তাদের বিপথে যাওয়া রোধ করার ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো ভূমিকা নিতে পারে। আবাসিক এলাকায় অবাধে মাদক বেচাকেনা বর্তমানে আরেকটি বড় সমস্যা। হাতের কাছে মুড়ি-মুড়কির মতো মাদক সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের একটা বড় অংশ মাদকাসক্ত হচ্ছে, এলাকার আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এলাকাভিত্তিক সমাজিক সংঘগুলো এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এলাকা মাদকমুক্ত রাখতে পারে। এলাকায় জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলা, জঙ্গি তৎপরতা চালানোর তথ্য পাওয়া যায় প্রায়ই। এ অপকর্ম চালানোও সহজ হবে না এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো সজাগ-সচেতন থাকলে। আবাসিক এলাকায় ডিস, ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া এবং বাড়ির ময়লা নেয়া লাভজনক বাণিজ্য। এসব ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ফ্যাসাদ, মারামারি, খুনোখুনি লক্ষ করা যায়। এতে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটে, একচেটিয়া বাণিজ্যের কারণে এলাকাবাসীকে গুণতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো ডিস, ইন্টারনেট, বাড়ি-ঘরের ময়লা নেয়ার খরচ কমাতে পারে প্রতিযোগিতামূলক দরে এ সেবাগুলো প্রদানের ব্যবস্থা করে। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো নিজ নিজ এলাকায় এ সেবাগুলো প্রদানের জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সুযোগ করে দিলে এলাকাবাসীর প্রতিযোগিতামূলক দরে এ সেবাগুলো পাওয়া নিশ্চিত হবে। এতে কম খরচে এ সেবাগুলো পাবে এলাকাবাসী। এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায়ও এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘ ভূমিকা রাখতে পারে। এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণ করে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না দেয়া, এলাকা অসামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘের প্রহরীর ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো এলাকায় পাঠাগারের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে এলাকার উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের পাঠ অভ্যাস হবে, যা তাদের সুমানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো এলাকায় সংঘটিত ছোট-খাট সামাজিক অপরাধের বিচার, এলাকাবাসীদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিরোধ থাকলে সেসব বিরোধ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার ব্যবস্থা করে এলাকায় শান্তির আবহ বজায় রাখতে পারে।
সকল প্রকার অনাচার, দূরাচার, অপরাধপ্রবণতামুক্ত রেখে এলাকাকে আদর্শ এলাকার রূপ দিতে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘের ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ আছে। একসময় পুরনো ঢাকায় এলাকাভিত্তিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। পঞ্চায়েতগুলো এলাকায় সামাজিক বিচার-আচার করাসহ এলাকাবাসীর কল্যাণে ভূমিকা রাখত। এতে এলাকায় অপরাধ কম হতো, এলাকাবাসীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতার মানসিকতা গড়ে উঠত, এলাকায় শান্তিতে বসবাসের নিশ্চয়তা থাকত। এলাকাভিত্তিক সংঘগুলো কেবল বিশেষ দিবস, পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠান ঘটা করে উদযাপন, বাৎসরিক পিকনিকে সীমাবদ্ধ না থেকে এলাকা ও এলাকার মানুষের কলাণে ব্যাপক পরিসরে কাজ করতে পারে । এলাকাভিত্তিক সমাজিক সংঘগুলো এলাকার সার্বিক কল্যাণ-উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের সাথে (বার্গেনিং এজেন্টের আদলে) আলাপ-আলোাচনা, দরকষাকষির এজেন্ট হতে পারে। এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফেডারেশনও গঠন করতে পারে। এতে এলাকার ও এলাকার মানুষের কল্যাণে অধিকতর অবদান রাখার সুযোগ হবে। চেষ্টা করলে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংঘগুলো হতে পারে এলাকার শান্তি-নিরাপত্তা, এলাকায় নির্বিঘ্নে বসবাসের নিশ্চয়তার গ্যারান্টার। বলা যায়, আদর্শ এলাকা গড়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগ আছে এলাকাভিত্তিক সমাজিক সংঘের।
লেখক: কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন