করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার রোধে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ১. ২১ জানুয়ারি থেকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে। ২. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ৩. রাষ্ট্রীয়/সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয় সমাবেশ/অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট/২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে। ৪. সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দায়িত্ব বহন করবে। ৫. বাজার, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সবধরনের জনসমাবেশে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ৬. বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনিটর করবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনসহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত ১০ জানুয়ারি ১১টি বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, যা ১৩ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে কার্যকর হয়। যদিও সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে জনসচেতনতা পরিলক্ষিত হয়নি, বরং তা বহুলাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। নতুন বছরের শুরু থেকেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট চোখ রাঙাচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরে দেশে করোনার দৈনিক সংক্রমণ হঠাৎই বাড়তে শুরু করে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন পুনরায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হলো এবং তাদের শিক্ষাজীবন আরো দীর্ঘায়িত হবার শঙ্কা তৈরি হলো। তবে ইতোমধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। দেশের করোনা পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি হচ্ছে, যে মাত্রায় সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে তা দেশের শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পুনরায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত বছরের লকডাউনে বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। বলার মতো কোনো নতুন কর্মসংস্থান দেশে আজও সৃষ্টি হয়নি। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের পাদচারণায় মুখোরিত হতে, প্রাণ ফিরে পেতে চলেছিলো মাত্র, তখনই এধরনের ঘোষণা শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় আঘাত এলো। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ যেন কোনভাবেই দীর্ঘায়িত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
এমনিতেই শিক্ষা ক্ষেত্রে যে সেশন জটের সৃষ্টি হয়েছে, আজকের ঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্য দিয়ে তা আরও দীর্ঘায়িত হবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা গেলে এ ক্ষতি অনেকাংশে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। অবশ্য তা দেশের প্রাথমিক ও গ্রামাঞ্চলের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন বেশ কষ্টকর হয়ে পড়বে। গ্রামের অনগ্রসর পরিবারের সন্তানদের পক্ষে ব্যয়বহুল প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়মিত অংশগ্রহণ অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া ইন্টারনেটের ধীরগতি, অ্যান্ড্রয়েড ফোন সেট না থাকা ও ইন্টারনেটের চড়া মূল্যের কারণে দেশে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এখনও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য শিক্ষা পদ্ধতির স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। দেশে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তার সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমকে চালু রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়সমূহের গভর্নিং বডি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিবিড় সুপারভিশন এই কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা নিয়ে ইতোমধ্যেই সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানালেও প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা একই সাথে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখারও দাবি জানিয়েছে। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা অনেকটা ব্যয়বহুল পদ্ধতি হওয়ায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘদিন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা অনেকাংশে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে সরকার শিক্ষার্থীদের ডাটাবেজ তৈরি করে মোবাইল কোম্পানির সাথে চুক্তি করে শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রি ইন্টারনেট সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে দেশে জনপ্রিয় ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যেত।
সরকার একই আদেশে করোনার ঝুঁকিহ্রাসে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে অর্ধেক জনবল নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। এতে করে বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পুনরায় চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোনভাবেই যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের কর্মী ছাঁটাই করতে না পারে বা তাদের বেতন বন্ধ করে দিতে না পারে সে বিষয়ে সরকারের দৃশ্যমান তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।
করোনা সারা বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে নাজুক করে তুলেছে। করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রণ ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। মানব সভ্যতা অনেকটা স্থবির। রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ দখল করা গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অনেকটা শঙ্কার মধ্যে মধ্যে পড়ে যাবে সন্দেহ নেই। যদি দেশে করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়, বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য দারুণভাবে ব্যাহত হবে। তখন সঙ্গতকারণে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাগণ পণ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলম্ব করতে পারে। ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত মালিক-শ্রমিক উভয়কে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই জীবন ও জীবিকা একইসাথে সচল রাখার জন্য এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে আরো কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। এ ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য দেখানো বা শৈথিল্য প্রদর্শন পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
drhasnat77@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন