রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ছাত্রদের আন্দোলন করতে হবে কেন?

মাহমুদুল হক আনসারী | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

ছাত্রদের কাজ হচ্ছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। ছাত্রত্ব বজায় রেখে লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শৃংখলা মেনে চলা। ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি না করা। ছাত্র এবং শিক্ষক একে অপরের সহযোগী। ছাত্র তার শিক্ষক থেকে প্রয়োজনীয় ক্লাসের দিক নির্দেশনা ও শিক্ষা অর্জন করবে। ছাত্র মনোযোগী হবে শিক্ষকের প্রতি। আর শিক্ষক ছাত্রকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান প্রদান করবে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষক, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশিরভাগ জাতীয় এবং বেসরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে অভিভাবক মহল তার সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগান। একসময় পাড়া মহল্লায় লজিং টিউশনি করে ছাত্ররা পড়ালেখা করতো। অজ পাড়া-গাঁয়ের মানুষের মধ্যে একটা ভালোবাসা ছিলো শিক্ষার্থীদের প্রতি। শিক্ষার্থীরা ঘরে ঘরে টিউশনি করে নিজদের পকেট খরচ নির্বাহ করতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে এভাবে উচ্চশিক্ষার্থীগণ লেখাপড়া করেছিলো। খরচও নির্বাহ করতো। আজকাল তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বলতে গেলে লজিং প্রথা উঠে গেছে। এখন সেই আগের যুগের মতো ছাত্রদের লজিং রাখা হয়না। বহু গ্রামে খবর নিয়ে দেখা গেছে, লজিং প্রথা নেই। সেক্ষেত্রে এখন এলাকায় এলাকায় কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যে শিক্ষার্থীরা লজিংয়ের মাধ্যমে পড়াশুনা শিখতো, এখন তারা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে কোচিং সেন্টার নির্ভর শিক্ষা অর্জন করছে। অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে টিউশন ফি দিয়ে শিক্ষা নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোচিং এবং টিউশনি চালু হয়েছে। এ কোচিং ও টিউশনির জন্য অভিভাকদের প্রচুর অর্থ গুণতে হয়। পরিস্কারভাবে বলা যায়, অর্থ আছে যার শিক্ষা তার। অর্থ আছে যার, চিকিৎসা প্রাপ্তি তার। অর্থ ছাড়া শিক্ষা আর চিকিৎসা কিছুই পাওয়া যায় না। অর্থ লাগবেই। একসময় ডাক্তারদের মধ্যে রোগীর প্রতি ভালোবাসা আর মানবিকতা দেখা যেতো। এখন সেটা নেই বললেই চলে। ডাক্তারের চাহিদামতো অর্থ প্রদান করেও ভুল চিকিৎসার সংবাদ প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় যত ধরনের আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, সবগুলোতেই কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অর্থ খরচ ছাড়া প্রাইমারি লেভেল থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত কোথাও শিক্ষা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যার কাছে অর্থ নেই, সে শিক্ষা নিতে পারছে না। এই যে সন্তানের শিক্ষার পেছনে এত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা কে যোগান দিচ্ছে? নিশ্চয়ই অভিভাবক। কে সেই অভিভাবক, তিনি একজন কৃষক, তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তিনি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ মানুষের আয়-ইনকাম সীমিত। তবুও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে জমি-জমা বিক্রি অথবা বন্ধক রেখে অনেকেই তার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছায়। তার সন্তান লেখাপড়া করবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে, একদিন সেখান থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হবেÑএ স্বপ্ন সকল অভিভাবক দেখে থাকে। শিক্ষা শেষে একটা চাকরী খুঁজে নেবে, তারপর পরিবারের কিছুটা হলেও সাহায্য সহযোগিতা করবে, এমনটিই অনেক অভিভাবক আশ করেন। এর মধ্যেও অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আন্দোলন, রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষের কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকে। সেটা এক কালো অধ্যায়। অথচ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব হলো লেখাপড়া করা। সে আন্দোলনে কেনো যাবে? তাকে দিয়ে কেনো একটা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি হবে? কেনোই বা তাকে রাস্তায় নামতে হবে? এসব কিছুর জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের নিকট প্রত্যাশা করছি। কোনো ইস্যু নিয়ে ছাত্র আন্দোলন অভিভাবকরা চায়না। এসব বন্ধ করতে হবে। এদেশের সাধারণ মানুষ কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে প্রিয় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে। কেউ কাউকে ৫ টাকা দেয়না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেসরকারী ছাত্রদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থ খরচ করেনা। যারা অর্থ খরচ করে সন্তানদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সন্তানদের আন্দোলনমুখী করে যারা নোংরা রাজনীতি করছে, অভিভাবক মহল তাদের ঘৃণা করে। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষাকেন্দ্রে রাজনীতি না করা। ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে ঠেলে না দেয়া। রাজনীতি করার সময় বয়স সুযোগ আসবে। কিন্তু ছাত্রত্বের বয়স শেষ হয়ে গেলে সে সময় আর ফিরে আসবে না। করোনার মধ্যে বলতে গেলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চলছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি অন্যান্য শিল্প-কারখানা, মার্কেট সবই খোলা। সরকার কি ভেবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে, সেটা বোধগম্য নয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি সব ধরনের অফিস-আদালত, মার্কেট চলতে পারে, তাহলে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে! গণপরিবহণের জন্য সরকারী রুল জারি করা হলেও তারা সেটা না মেনে তাদের মতো করে গণপরিবহণ চালু রেখেছে। সবকিছু যদি ঠিকঠাক মতো চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে কি সমস্যা? আবার সরকারী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মতো করে সবকিছু চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে পরীক্ষা এবং শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এতে করে তারা সেশন জটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। করোনা কি শুধু তাদের জন্যেই? সরকারের হিসেব মতে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ লেভেলের ৮০ পার্সেন্ট ছাত্র-ছাত্রী দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে। এই টিকা প্রদান এখন প্রাইমারী লেভেলে পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। তাহলে টিকা যখন ছোট-বড় সব বয়সের ছাত্রদের মধ্যে অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে, তখন মহামারীর ভয়ে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা এবং ক্লাস বন্ধ করার কী কারণ থাকতে পারে, সেটা অভিজ্ঞ মহলে জোর আলোচনা চলছে। সরকারকে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী পরিকল্পনার মধ্যে চলা দরকার। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বয়স দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চাকরীর বয়স চলে যাবে। ছাত্র-অভিভাবক উভয়ের কপালে হাত উঠবে। আফসোস আর হতাশার মধ্যে তাদের জীবনে নেমে আসবে অশান্তি আর ভোগান্তি। এর পিছনে দায়ী কারা, শুধুমাত্র কোভিড-১৯ এর দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর পিছনে অন্যকোনো কারণ বা হেতু আছে কিনা, তাও ভেবে দেখতে হবে। ছাত্রদের জীবন নিয়ে কোনো অভিভাবক কাউকে খেলতে দেবে না। তাদের কাজ তাদেরকে করতে দিন। ক্ষমতার পরিবর্তন অথবা কাউকে ক্ষমতায় উঠানো তাদের কাজ নয়। তাদের শিক্ষাজীবন সময়মতো শেষ করতে সকলকে সহযোগিতা করতে হবে। তারা যাতে সময়মতো কর্মজীবনে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে সুযোগ তাদের জন্য করে দেওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কর্মসংস্থান তৈরি করুন। ঘরে ঘরে চাকরী দিবেন, বেকারত্ব দূর করবেন এমন প্রতিশ্রুতি সরকারের ছিল। সেটা বাস্তবায়ন করতে বে। অহেতুক ছাত্রদের আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন নেই। অভিভাবকরা এসব মোটেও পছন্দ করে না। ছাত্রদেরকে ক্লাসে ফিরে যেতে সহযোগিতা করুন। তাদেরকে যেনো দেশের যেকোনো আন্দোলনের জন্য ইস্যু করা না হয়। আসুন, আগামী দিনের সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে আসি।

লেখক: সংগঠক, গবেষক, লামিষ্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন