মাঘের তৃতীয় সাপ্তাহ চলছে। এখনই ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পদ্মার পানি আটকে দেয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ভারত চুক্তি অনুযায়ী পানি না দিয়ে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তা অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ায় এখনই পদ্মা নদীর পানির স্তর নীচে নেমে গেছে। এমনিতেই ঘন কুয়াশা, তার মধ্যে নদীর পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ও বাংলাবাজার নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই ঘন কুয়াশা; তার মধ্যে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় ফেরি চলাচল ব্যহত হচ্ছে। সামনে ফাল্গুন-চিত্র মাসে পদ্মার পানির স্তর আরো কত নীচে চলে যায় সেটাই শঙ্কা।
পৌষ-মাঘে সামান্য কুয়াশা পড়লেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোতে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ও বাংলাবাজার নৌ ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ায় যানবাহন মাইলের পর মাইল যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এতে যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে আর পণ্যবোঝাই ট্রাক আটকে থাকায় কাঁচাপণ্যের ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়। এই চিত্র বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
পদ্মার পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া এবং কুশায়ার কারণে ফেরি চলাচল ব্যহত হচ্ছে। অথচ এসব দেখেও ঘুমিয়ে সময় পার করছে বিআইডব্লিউটিসি। ডিজিটালের এই যুগে ফেরি চলাচলে মান্ধাত্বার আমলের অ্যানালগ পদ্ধতি চলছে; অথচ সেটাও তদারকির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম।
প্রশ্ন হচ্ছে নৌ রুটের গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে যারা বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন; বিআইডব্লিটিসি’র সেই কর্মকর্তারা কি ঘুমিয়ে থাকেন? ডিজিটাল যুগে যোগাযোগের এই অ্যানালগ ঘাটগুলোর ফেরি চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন তা রহস্যজন। কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচল অব্যাহত রাখতে ফেরিফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে বহুদিন ধরে। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত নৌ পথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় কোটি টাকার ফগ লাইট, ক্যামেরা ও রাডার সবই বিকল। এমনকি ফেরি রাডার ও সব শেষ ফেরি গোলাম মওলায় স্থাপন করা ক্যামেরা সবই বিকল। প্রতিদিন ফেরি ঘাটগুলোর যাত্রী দুর্ভোগ এবং মাইলের পর মাইল ধরে পণ্য বোঝাই ট্রাকের লাইনের দৃশ্য গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে। অথচ দায়িত্বশীলরা নির্বিকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি লাঘব করতে ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইন লাগানো হয়। ২০১৪ সালে ৯টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট স্থাপন করা হয়। দীর্ঘ ৭ বছর আগে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট সংযোজন করা হলেও সেগুলো নস্ট হয়ে রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়েও লাইটগুলো সংস্কার বা মেরামতের কোন উদ্যোগ নেয়নি বিআইডব্লিটিসি।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিটিসি আরিচার ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, কুয়াশা বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেন। আর ফগ লাইট এখন ডেড কেস। এ নিউজ করে এখন কোন লাভ নেই।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ভোগান্তি লাঘবে ঘাট কর্তৃপক্ষের নেই কোন পদক্ষেপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ। ঘাটে ঘাটে দিনভর যানজট থাকলেও রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে বিআইডব্লিটিসি কর্মকর্তারা। এদিকে ভোগান্তি লাঘবে ২০১৪ সালে ৯টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট স্থাপন করা হলেও সেগুলো বিকল পড়ে আছে বছরের পর বছর। এমনকি ফেরি রাডার ও সব শেষ ফেরি গোলাম মওলায় স্থাপন করা ক্যামেরা সবই রয়েছে বিকল। প্রায় ৫ কোটি টাকা দিয়ে কেনা ফগ অ্যান্ড লাইটগুলো এখন ডেড কেস বলছেন বিআইডব্লিটিসি আরিচার ডিজিএম।
শীতের শুরুতেই ভোগান্তি শুরু হয়েছিল দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে। কুয়াশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে ফেরি। সর্বশেষ গত সোমবার সকাল ৭টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে।
এর আগে নৌরুটে ভোগান্তি কমাতে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে চলাচলকারী, খানজাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত ও কে-টাইপ ফেরি কপোতি, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত ও শাহ পরান ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট সংযোজন করা হয়। লাইটগুলো সংযোজন করার পর থেকেই কোন কাজে আসেনি। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা এই লাইট। ফলে এ বছরও কুয়াশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকছে ফেরি। যাত্রী ও চালকরা বলছেন সরকারের পুরো টাকাই বিফলে গেছে। হয়েছে বড় ধরনের লুটপাট। যে কারণেই নেই কোন তদারকি।
কয়েকটি ফেরি চালকের সঙ্গে কথা বললে চালকরা জানান, একটু কুয়াশা পড়লেই বন্ধ রাখা হয় ফেরি। তিন চারদিন রাস্তায় আটকে থেকে বাড়ছে খরচ। গাড়ি থেকে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এর উপর রয়েছে দালাল ও অসাধু কর্মকর্তাদের উৎপাৎ।
বাস চালকরা জানান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে বসে থাকতে হচ্ছে। এতে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এই দুর্ভোগ দেখার যেন কেউ নেই। প্রতি বছর এই ভোগান্তি থাকে কিন্তু সরকারের নজরে আসে না বিষয়টি।
ফেরি রুহুল আমীনের সুকানী (চালক) হারুন অর রশিদ জানান, কুয়াশায় ফেরি চলাচল মাঝে মাঝেই ব্যহত হচ্ছে। যাত্রী ও যানবাহন নিয়ে মাঝ নদীতে আটকে থাকতে হচ্ছে। আপাতত কুয়াশা ছাড়া এই নৌরুটে কোন সমস্যা নেই।
এদিকে, শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ও বাংলাবাজার নৌ-রুটে ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচলে ধীরগতি এবং সীমিত ফেরি চলাচলে দীর্ঘ সৃষ্টি হয়েছে যানজটের, দুর্ভোগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পদ্মা সেতুর পিলারে একাধিক ধাক্কা লাগার পর মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া এবং মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌরুটে চলাচলের সময় ও ফেরির সংখ্যা কমানো হয়। বর্তমানে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাত্র চারটি ফেরি যানবাহন পারাপার করছে।
এছাড়াও শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি রুটে রাতে ২টি ফেরি চলাচল করছে। ঘন কুয়াশার কারণে ধীর গতিতে ফেরি চলাচল করায় এবং সীমিত ফেরি চলাচলে এতে ঘাটে এসে যানবাহন দীর্ঘ সময় আটকে থাকছে। যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কখনো কখনো সময় ফুরিয়ে যাওয়ায় ফেরিতে উঠতে না পেরে বিকল্প নৌপথ ব্যবহারে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের।
যাত্রীরা জানান, ধীর গতিতে ফেরি চলাচলের কারণে ১ দিনের বেশি সময় ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় আটকে থাকতে হচ্ছে। শীতের মধ্য পরিবার নিয়ে ঘাটেই থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। আগে ১৭টি ফেরি দিয়ে পারাপার করা হতো এখন মাত্র ৪টি ফেরি চলছে। ফেরির সংখ্যা না বাড়ালে পারাপারে ভোগান্তি আরোও বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর বর্ষা মৌসুমে পদ্মা সেতুর পিলারে একাধিকবার ফেরির ধাক্কা লাগে। এরপর দুর্ঘটনা এড়াতে গত বছর ১৮ আগস্ট থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ৪৭ দিন পর গত ৫ অক্টোবর সীমিত আকারে ফেরি চলাচল শুরু হয়। তবে তীব্র স্রোতের কারণে ছয় দিন চলার পর আবারও ফেরি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর গত ৮ নভেম্বর থেকে পুনরায় ফেরি চালু হয়েছে। বেগম রোকেয়া, কুঞ্জলতা, কদম ও সুফিয়া কামাল নামের চারটি ফেরি শুধু হালকা যানবাহন পারাপার করছে। পূর্ব ঘোষণা থাকলেও দক্ষিণাঞ্চলগামী ২১ জেলায় যাতায়াতকারী অসংখ্য ছোট যানবাহন প্রতিদিন ঘাটে আসছে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, এর আগে এ রুটে ১৭টি ফেরি দিয়ে পারাপার করা হতো। এখন ২টি রুটে ৬টি ফেরি দিয়ে পারাপার করা হচ্ছে। ফেরি বাড়ানোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ থেকে এখনো কোন সিদ্ধান্তে আসেনি। পদ্মায় প্রবল স্রোত, নাব্যতা সঙ্কট ও পদ্মা সেতুর সঙ্গে ফেরির ধাক্কার ঘটনায় দীর্ঘদিন এ রুটে ফেরি সার্ভিস বন্ধ ছিলো। এখন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সীমিত সংখ্যক ছোট যানবাহন নিয়ে ৪টি ফেরি চলাচল করছে। পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির নির্দেশে ফেরি সংখ্যা বাড়ানো হবে। তাদের সিদ্ধান্ত পেলেই এ রুটে ফেরির সংখ্যার বৃদ্ধি করা হবে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন