দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স প্রবাহ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সউদী শ্রম বাজার অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে সউদী আরবে সেবাখাত ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে রয়েছে বিশ লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী ও বিনিয়োগকারীর অসামান্য ভূমিকা। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সউদী আরব ও বাংলাদেশের দূতাবাস, কনস্যুলেট অফিস ও শ্রম উইংয়ের সংশ্লিষ্টদের কর্মকান্ডে এক ধরণের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগসহ প্রাসঙ্গিক ভিসা কার্যক্রমে নানাবিধ জটিলতা, অনিশ্চয়তা, অহেতুক শর্ত ও প্রতিবন্ধকতা আরোপ করতে দেখা গেছে। এইসব বাস্তবতা সত্ত্বেও সউদী শ্রম বাজারে বাংলাদেশী কর্মীদের গমনাগমন কখনো বন্ধ থাকেনি। গত দুই বছরের করোনাকালীন বাস্তবতা ডিঙ্গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে, তখন সউদী আরবের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের যোগদানের ক্ষেত্রে আবারো অস্বচ্ছ প্রতিবন্ধকতা দেখা যাচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, করোনাকালীন স্থবিরতা কাটিয়ে দেশের প্রবাসি কর্মীরা সউদী আরবে যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিলেও দূতাবাস থেকে স্ট্যাম্পিং না করে প্রায় অর্ধেক পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সউদী আরবের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে রিক্রৃুটিং এজেন্সিগুলোর বচসা ও দূরত্ব সৃষ্টির তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। সময়মত কর্মী পাঠাতে না পারায় এজেন্সিগুলো সুযোগ হারানোর আশঙ্কা করছে।
সউদী-মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশ মিশন এবং শ্রম উইংয়ের কর্মকর্তা ও কর্মীদের বেপরোয়া দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতার কারণে রেমিটেন্স যোদ্ধা বাংলাদেশী কর্মীদের নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জমিজিরাত বিক্রি ও ধারদেনা করে বিদেশ গিয়ে বছরের পর বছর ধরে শ্রম দিয়ে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করছেন। এদের অনেকেই ছুটিতে বা ভিসার মেয়াদশেষে দেশে ফেরার সময় দেশের বিমানবন্দরে অমানবিক হয়রানি, বিড়ম্বনা ও প্রতারণার শিকার হন। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন প্রবাসী কর্মী তার মূল্যবান লাগেজ হারিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডরমেটরিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করছেন। প্রায় প্রতিদিনই বিমানবন্দরের অসাধু কর্মীদের দ্বারা প্রতারিত ও ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। এসব দেখার যেন কেউ নেই! আদম বেপারির দালাল, অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সীর কর্মী, সউদী আরবের নিয়োগকর্তা থেকে শুরু করে বাংলাদেশী কনস্যুলেট অফিসের কর্মী ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নানাবিধ অবহেলা ও তদবির বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্রমবাজার ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসের দীর্ঘসূত্রিতা তথা স্ট্যাম্পিং না করে রিক্রুটিং এজেন্সীগুলোতে পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার জেরে প্রতিমাসে হাজার হাজার কর্মীর নিয়োগ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
সউদী আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার আমাদের অর্থনীতি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। করোনা লকডাউনের সময় হাজার হাজার কর্মী দেশে এসে আটকা পড়েছিল। এখন সউদী আরবে পুরোদমে উন্নয়ন প্রকল্প ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু হওয়ায় কর্মীদের কাজে ফিরে যাওয়ার চাপ বাড়ছে। এহেন বাস্তবতায় দূতাবাস কর্মীদের আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে বেশি সংখ্যক ভিসা সংক্রান্ত নিরীক্ষা ও স্ট্যাম্পিং করার কথা থাকলেও সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই তারা অর্ধেক ভিসা সরবরাহ করছে। এর ফলে লাইনে থাকা অনেক কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আবারো ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। প্রবাসিদের জন্য এই বাড়তি খরচ বোঝার উপর শাকের আঁটির মত দুর্বহ। প্রবাসী শ্রমিকদের বাড়তি খরচ ও ভিসা জটিলতার কারণে কাজে যোগ দেয়ার অনিশ্চয়তা শুধু শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংকটই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, এর ফলে দেশের প্রতাশ্যিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স প্রবাহে নতুন আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। নিয়োগকারীদের চাপ থাকা সত্ত্বেও সউদী দূতবাস কেন ভিসা ফেরত দিচ্ছে তার সঠিক তথ্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে নেই। অনেকের অভিযোগ, দূতাবাসের অভ্যন্তরের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই ভিসা ফেরত দেয়ার অন্যতম কারণ। বায়রার পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের কাছে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ দাবি করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের উচিৎ অনতিবিলম্বে সশ্লিষ্ট সউদী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত এ অবস্থার নিরসন করা। দেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ ও লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের এমন শীতল ভ’মিকা দু:খজনক। বিমান বন্দরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার সার্টিফিকেট নিয়েও নানা রকম জাল-জালিয়াতি ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এসব বিষয়ে সরকারকে আরো কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন