ভারত থেকে বানের পানির মতো অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আসছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য দেশের যুবকদের সন্ত্রাসী ও মাদকাসক্ত বানিয়ে তাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটা কোনো নতুন খবর নয়। দেশে এক চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। সামাজিক অপরাধ, নৈতিক অবক্ষয় এবং নিরাপত্তাহীনতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। সরকার যখন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে তখন সামাজিক-মানবিক অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপলাভ করছে। নারী-শিশু, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সাধারণ ব্যবসায়ীসহ কেউই ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। প্রতিদিনই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হাতে লাশ পড়ছে, নারী ও শিশুরা নরপশুদের লালসা ও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা নিজেরাও মারামারি করে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্বববিদ্যালয় ও জনপদে প্রতিদিন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে, পরস্পরের অস্ত্রে আহত-নিহত হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি শহরে ও জনপদে চিহ্নিত সন্ত্রাসীচক্র এবং সরকারি দলের পরিচয়ধারী অঙ্গসংগঠনের অস্ত্রধারী কর্মীরা বেপরোয়া সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, খুনখারাবি চালাচ্ছে। তারা প্রকাশ্য অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরছে না, দেখেও না দেখার ভান করছে। সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না, তাদের পরিচয় শুধুই সন্ত্রাসী, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা প্রায়ই এমন বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বললেও এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে প্রকাশ্য সন্ত্রাস-অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে চার লক্ষাধিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এটি অন্তত বছরখানেক আগের তথ্য। প্রতিদিনই সীমান্তপথে অস্ত্র আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এবং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর খুব কম সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। মূলত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ। লাখ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি লাইসেন্সকৃত হাজার হাজার আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধভাবে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলেও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও রাজনৈতিক পরিচয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। যানজটে আটকে পড়ে মেজাজ খারাপ করে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করার উদাহরণও আছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যও অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়। ভারতের সাথে শত শত কিলোমিটার সীমান্তপথে অন্তত ২০টি রুট দিয়ে নিয়মিত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক প্রবেশ করলেও বিজিবির হাতে এসব অস্ত্র ও মাদক ধরা পড়ার হার খুবই কম। একদিকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ব্যর্থতা, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও প্রয়োজনীয় তৎপরতার অভাবেই অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটে চলেছে। অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের তালিকা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে নিশ্চয়ই আছে। পত্রিকায় এ সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এসব অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ সুযোগে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এখন সীমান্ত পেরিয়ে খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে এসে অস্ত্র কেনাবেচা করছে। গত মঙ্গলবার ডিবি পুলিশের হাতে ১০টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিনসহ আটক ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে এমন তথ্য আবারো পাওয়া গেছে। ডিবির হাতে ধরা পড়ার আগে কথিত ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ী আরো বহুবার অস্ত্রের চালান নিয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল বলে জানিয়েছে। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে অনেকটা বিনা বাধায় ভারতীয় সিন্ডিকেট বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করছে।
অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসায় দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গত বছর ঢাকার কূটনৈতিক জোনে এবং দিনাজপুরে বিদেশী নাগরিক হত্যা, চলতি বছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের আগে নাশকতার চেষ্টা ইত্যাদি প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনায়ই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ভারত থেকে এসেছে এবং ভারতেই নির্মিত হয়েছে বলে ইতোমধ্যে প্রকাশিত গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে। অধিকাংশ নাশকতার ঘটনার তদন্ত আলোর মুখ না দেখলেও অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় অস্ত্র অথবা ভারত-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। আর এসব অস্ত্রের এক বড় অংশ জমা হচ্ছে সরকারি দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর হাতে। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, দলে প্রভাব বিস্তার এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যেমন এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে তেমনি জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, টার্গেটেড কিলিং এবং গুম-অপহরণের ঘটনাগুলোতেও এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকার রাজপথ-ফুটপাথ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত একটি সচিত্র খবরে দেখা যায়, চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। এর মাত্র তিন দিন আগে ঢাকার গুলিস্তানে দুই ছাত্রলীগ নেতা প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এসব ঘটনায় লোক দেখানো বহিষ্কার করে সরকারি দল তার দায়িত্ব শেষ করছে। কখনো কখনো দু-একজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলেও অস্ত্র উদ্ধার এবং অস্ত্রের কেনাবেচার সিন্ডিকেট নির্মূলে কার্যকর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। দেশের বিভিন্ন স্থল ও নৌ-সীমান্ত দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক এসে দেশকে অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করে তুলেছে। দেশের বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও সামাজিক ব্যবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। এহেন বাস্তবতায় সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ও সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থে অবৈধ অস্ত্রের রুট বন্ধ করতে হবে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সারাদেশে চিরুনি অভিযান চালানো এখন সময়ের দাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন