শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অনন্য ব্যক্তিত্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)

ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:১৩ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আলেম সমাজের কাছে ছিলেন একজন উচ্চ পর্যায়ের আলেম। পীর-মাশায়েখের দৃষ্টিতে ছিলেন ওলীর নাতি, ওলীর আওলাদ, লাখ ওলীর ফয়েজপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন সকল মতাদর্শী রাজনীতিবিদের প্রাণপুরুষ। সমাজ উন্নয়নে তিনি ছিলেন সার্থক সমাজসেবক। শিক্ষক সমাজের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন মাদরাসা, স্কুল, কলেজের সকল স্তরের শিক্ষকের প্রাণের স্পন্দন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সফল মন্ত্রী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন সফল কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভাষা জ্ঞানে তিনি ছিলেন আরবি, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত। রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি ছিলেন সেরা বক্তা। জুমার মিম্বারে ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের খতীব। শুধুমাত্র মাদরাসায় লেখাপড়া করে তিনি প্রমাণ করেছেন মাদরাসায় পড়ুয়ারা দেশ চালাতে পারে। রাসুল প্রেমে তিনি ছিলেন বিভোর। সুযোগ্য শিক্ষক হিসেবে তিনি কত উঁচুমানের ওস্তাদ ছিলেন তার দরসে না বসলে তা বুঝা যেত না। পুরো কুরআন শরীফকে যিনি একটি বাক্যে তারকীব তথা বাক্য বিন্যাসে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম ছিলেন। কুরআনকারিমের তাফসীর বর্ণনায় তিনি ছিলেন সফল মুফাস্সির। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ময়দানে তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুফতী। মাদরাসা, মসজিদ ও খানকা তৈরিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। পাঁচ হাজারের অধিক নবী প্রেমিককে মদীনা তাইয়্যেবা যিয়ারত ও হজে¦ বাইতুল্লায় যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।


তার অনন্য অবদানে মাদরাসা, স্কুল, কলেজের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা ৩ টাকা বেতন থেকে বর্তমানে ৬০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। দীনি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, যেখানে রয়েছে ফাযিল অনার্স, মাস্টার্স ও কামিল হাদিস, তাফসীর, ফিকহ ও আদব, কারিগরি শিক্ষার উন্নতমানের ব্যবস্থা। তার মহান পিতা যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত শাহ ইয়াসীন (রহ.) এর মাযার শরীফের পাশেই গড়ে তুলেছেন শাহ ইয়াসীন ফাযিল মাদরাসা ও হিফজখানা। নানার গ্রাম তার জন্মস্থান কেরোয়াতে প্রতিষ্ঠা করেছেন কেরোয়া হোসনে আরা বালিকা বিদ্যালয়, মাদরাসা বোর্ড সায়ত্বশাসিত হওয়া, বি.এম.টি.টি.আই প্রতিষ্ঠা, ফাজিল-কামিলের মান উন্নয়ন তার অনন্য অবদান। তারই সূত্র ধরে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি এ এম এম বাহাউদ্দিন, কবি রূহুল আমীন খান, মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজীসহ জমিয়াতুল মোদার্রেছিনের এক ঝাঁক আলেম-ওলামার আন্দোলন, তালাবায়ে আরাবিয়া, তালামিযে ইসলামিয়াসহ ছাত্র সংগঠনসমূহের জোরদার তৎপরতা এবং ছাহেব কেবলা ফুলতলী (রহ.) এর লংমার্চের ফসল আজকের ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।

গাউসুল আজম কমপ্লেক্স, জমিয়ত অফিস তার অনন্য কীর্তি, যা ঢাকার একটি দর্শনীয় আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দৈনিক ইনকিলাব সাংবাদিকতা, দ্বীনের প্রচার ও প্রসার, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দ্বীনি আন্দোলনকে বেগবান করা, মাদরাসা শিক্ষার অভাব অভিযোগ তুলে ধরার ক্ষেত্রে একক নেতৃত্ব ও ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। দ্বীনি দাওয়াতে ইনকিলাব মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর অনন্য সৃষ্টি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে, সহী আকীদা প্রচারে, মিলাদ কেয়ামে, দোয়া-কালামে, যিকর-আজকারে তিনি ছিলেন অগ্র সেনানী। জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও ইসলামি উম্মাহর চেতনা সৃষ্টিতে তার কর্মতৎপরতা ছিল মাইলফলক। নানা মত ও পথের নেতাদের মাঝে অপূর্ব সমন্বয় সাধনের চৌম্বকীয় ক্ষমতা রাখতেন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। শত বিরোধ-বিভক্তি নিয়েও বিভিন্ন চিন্তার নেতারা মাওলানার ডাকে এক টেবিলে বসতেন। তার যুক্তি, দলিল ও বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে সহনশীলতা এবং উদায়তার এক বৃত্ত সৃষ্টি হতো। মাওলানা ছিলেন জ্ঞানপিপাসুদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

একবার রাত ১১টায় দেখা করতে গিয়েছিলাম তিন বন্ধুকে নিয়ে। দেখি তিনি একাগ্র চিত্তে বোখারী শরীফ পড়ছেন। বললাম, ‘চাচা আপনি অসুস্থ, রেস্ট নেয়া প্রয়োজন।’ হেসে বললেন, ‘ভাতিজা, একজন আলেমের কাজ হলো কিতাব মোতালায়া তথা ভালভাবে বুঝে পড়া। আজকে বহু আলেম নামধারী নেতাকে দেখি কিতাবের ধারে কাছেও নেই।’ তার একটি মূল্যবান কথা আমাকে এখনো নাড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘মাহবুব, শুধু কিতাব পড়লে, পড়ালে বা বুঝালেই চলবে না, এর জন্য চাই গভীর সাধনা, ছাহেবে ইলম তথা প্রিয় নবীজির সাথে রূহানী সম্পর্ক। তা না হলে আসল ইলম পাবে না। কারণ, তিনিই তো ইরশাদ করছেন, আল্লাহ দানকারী আর আমি (মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বণ্টনকারী।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘হযরত, এ রূহানী সর্ম্পক স্থাপনের উপায় কী?’ বললেন, ‘সাদেকীন তথা আল্লাহওয়ালাদের সোহবত-সাহচর্য, সান্নিধ্য, খেদমত, নেসবত এবং বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা।’ তার একথাগুলো যেন প্রতিদিন মানসপটে ভেসে উঠে। আজকের এ যুগে আমরা প্লাস্টিকের ফুলের মতো, যার নেই সুবাস, নেই রূহানী আকর্ষণ। তিনি ছিলেন সত্যিকারে গোলাপ, যার খুশবু কিয়ামত পর্যন্ত ঘ্রাণ ছড়াতেই থাকবে। আজকে ইসলামী শিক্ষার উপর নানামুখী আঘাত আসছে, আধুনিকতার নামে মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। দ্বীনি অঙ্গনে চলছে নেতৃত্বের চরম সংকট। এ মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল মাওলানার মতো নেতার। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের। সাবেক সচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি এ জেড এম শামসুল আলম তাই তো লিখেছেন, ‘মাদরাসার শিক্ষার উন্নয়নে, শিক্ষকদের কল্যাণে মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান উপমহাদেশে অতুলনীয়। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বৃটিশদের উপমহাদেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ বিলীন না হলেও আধমরা হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।’ (দৈনিক ইনকিলাব ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যা)

দেশ ও জাতির জন্য তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ। তার প্রমাণ মেলে ১৯৮৮ সালের শতাব্দীর ভয়াভহতম বন্যা ও দুর্যোগের সময় ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে। ব্যক্তিগত পরিচিতি, খ্যাতি, যোগাযোগদক্ষতা কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। মুসলিম বিশে^র সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে তিনি সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করেন। তার রেখে যাওয়া জমিয়াতুল মোদার্রেছীন, গাউসুল আজম কমপ্লেক্স, দৈনিক ইনকিলাব এদেশের মাদরাসা শিক্ষা, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মজিদিয়া শাহ ছুফী ইয়াসিনিয়া ইসলামি ফাউন্ডেশান, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাস, শাহ ইয়াসিন ফাজিল মাদরাসা, কেরোয়া হোসনে আরা বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনায় তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি আলহাজ¦ এ এম এম বাহাউদ্দীন, জনাব মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, মাওলানা কবি রুহুল আমীন খান, অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী, পরিচালক আবদুল কাদের ও আবুল খায়ের ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনন্য অবদান এদেশের জন্য দ্বীনি শিক্ষা অঙ্গনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আজকের এদিনে মাওলানার স্মৃতিকে সংক্ষেপে এভাবে ব্যক্ত করছি:

একটি নাম, একটি চেতনা, হাজার স্মৃতি অম্লান
দ্বীনি শিক্ষার উম্মেষ সাধনে সদা মহিয়ান
অবহেলার ঘোর তিমিরে মাদরাসা, আলেম সমাজ
যার অবদানে মহা সম্মানে মাথা উঁচিয়ে আজ
দ্বীনের কথা করতে প্রকাশ, দ্বীন প্রচারে ইনকিলাব
ঐক্য গড়ে সবার মাঝে যখন ছিল বাতিলের সয়লাব,
জমিয়তের চেয়ারে, ফেডারেশানের মঞ্চে, তিনি আকর্ষণ
বোখারীর দরসে, জুমার খোৎবায় দিয়েছেন নতুন প্রাণ
আশেকানের মিলন মেলায়, মসজিদে গাউসুল আজম
নবী-ওলীর প্রেম বিলাতে জুড়িহীন তার ভাষণ।
মজিদিয়া শাহ ইয়াসিনিয়া সহ হাজারো প্রতিষ্ঠান
ছোঁয়ায় তার হয়েছে অমর, দ্বীনি খেদমতে সদা কোরবান।
আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ইসলামী কাফেলার জমিয়ত
যার পরশে বাংলাভূমে, আল্লাহর এক রহমত
ওলীর সন্তান, ওলীর নাতি, লাখো ওলীর কালবে স্থান
যুগ যামানায় সিপাহসালার মাওলানা এম এ মান্নান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
M N Ahmed ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪২ এএম says : 0
মাওলানা এম এ মান্নান জনদরদী নেতা ছিলেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়নে এবং মাদরাসা শিক্ষকদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রভূত অবদান রেখে গেছেন। জমিয়াতুল মুদার্রেছীন নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে যে ঐক্য সাধন করে গেছেন তা এখনও শিরাধার্যরূপে বিদ্যমান।
Total Reply(0)
Jahidul Islam ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪২ এএম says : 0
বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আজীবন সভাপতি হিসেবে মাদরাসা শিক্ষায় বিস্ময়কর উন্নয়ন ও মাদরাসা শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ও মর্যাদাবৃদ্ধি মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহঃ)-এর অসাধারণ অবদান।
Total Reply(0)
Ujjal Hasan ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪২ এএম says : 0
I believe Alhaj Maulana M.A. Mannan, one of the topmost Alim of our country and he was a legendary person. May Allah give him Jannah.
Total Reply(0)
নুরুল আবছার ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪২ এএম says : 0
আল্লাহ তায়ালা মরহুমকে জান্নাতবাসী করুন। তার খেদমতকে কবুল করে দেশের আলেম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করুন। আমীন।
Total Reply(0)
Ibrahim Khalil ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪২ এএম says : 0
মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান মানুষে জন্য দুনিয়াতে যে খেদমত করে গেছেন সে কর্মসমূহের সওয়াব নিয়মিত পৌঁছাতে থাকবে, ইনশায়াল্লাহ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন