শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ইন্তেকাল বার্ষিকী সংখ্যা

স্মরণীয় মাওলানা এম এ মান্নান রহ.

মো. আবুল খায়ের ফরাজী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

মাওলানা এমএ মান্নান (রহ.)-এর জন্ম হয় চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ১৯৩৫ সালে। পিতা সুফী শাহ মো. ইয়াছিন (রহ.) ছিলেন ফুরফুরা শরীফের প্রখ্যাত পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীক (রহ.)-এর খলিফা, একজন উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মায়ের বাবা অর্থাৎ তাঁর নানাও ছিলেন পীর সাহেবের একজন খলিফা ও ওলীয়ে কামেল। মাওলানা হুজুর তখন নিতান্তই শৈশবে। এ সময় একবার তাঁদের বাড়িতে মাহফিলে আসেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও বক্তা ২৪ পরগনা জেলার বশিরহাটের মাওলানা রূহুল আমীন। বাড়ির শিশু বাচ্চাদের তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়। তখন তিনি এম এ মান্নানের চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন: ‘শাহ সাহেবের এই ছেলে একদিন দ্বীন-দুনিয়ার উভয় দিক থেকে বিশ্ববিখ্যাত হবে।’ ইতিহাস সাক্ষী, তাঁর এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) বহু গুণের অধিকারী একজন আলেম, পীর, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক সংগঠক ও নেতা ছিলেন। তিনি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সেবা ও উপকার করতেন। আত্মীয় ও কর্মী হিসেবে বহু বছর যাবৎ আমি তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বর্তমানেও হুজুরের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাবের সংস্থাপন নির্বাহী হিসাবে কর্মরত আছি। হুজুরের অনেক ইতিহাস আমি আমার মুরব্বীদের মুখে শুনেছি। আমি নিজেও অনেক ঘটনার সাক্ষী। এখন এসব না বললে একসময় সবই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। দীর্ঘ লেখা বা বর্ণনার স্থান এটি নয়। সীমিত আকারে কয়েকটি বিষয় বলার চেষ্টা করব।

হুজুর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর পিতা, পিতামহ এবং চাচা সবাই ছিলেন এলাকার প্রভাবশালী ও শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক এবং ওলী-দরবেশ, ফুরফুরা শরীফের খেলাফতপ্রাপ্ত। তারা হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রাচীন সমাজের শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামের আলো প্রজ্জ¦লিত করেন। তৎকালীন বড় বড় জমিদার হিন্দু হলেও প্রভাবশালী অনেক মুসলিম ব্যক্তি ও পাটোয়ারী ছিলেন। তারা সবাই হুজুরের পরিবারের ভক্ত থাকায় ইসলাম প্রচারে সুবিধা হতো। হুজুরের পিতা মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াসীন (রহ.) ঘোড়া ও পালকীতে চড়ে দূর-দূরান্তে দ্বীনের কাজে সফর করতেন। চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চরাঞ্চলে তাদের অনেক অবদান রয়েছে। মাওলানা এম এ মান্নান সাহেবও তরুণ বয়স থেকে শিক্ষক, সংগঠক ও পীর হিসেবে ভূমিকা রাখেন। কিছুদিন তিনি হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের খতিবও ছিলেন। বড় বড় মাদরাসায় তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ পড়াতেন। ফরিদগঞ্জ শাহ মজীদিয়া আলিয়া মাদরাসা তাঁর নানার নামে প্রতিষ্ঠিত। মাওলানা মান্নান হুজুর প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে তিনি তাঁর নানা মো. আব্দুল মজীদ (রহ.)-এর কাছে থেকে তাঁর মাদরাসায় শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তাঁর নানার বাড়ি ছিল চাঁদপুরের জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার কেরোয়া গ্রামে। সে সময় ফরিদগঞ্জ থানার রাস্তাঘাট, যানবাহন ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে পানি জমে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হতো। এতে করে সাধারণ মানুষ নৌকা বা ভেলা বানিয়ে চলাচল করতো, সে সময় তিনি মানুষের এ দুর্ভোগ দেখে চিন্তা করেন, কীভাবে রাস্তাঘাট উন্নয়ন করা যায়। তখন তিনি চাঁদপুর হতে শুরু করে হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, রামগঞ্জ, রায়পুর এলাকায় বেড়িবাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করেন। যখন তিনি পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হন, তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান আল-মাদানী সাহেবকে দিয়ে সম্পূর্ণ প্রজেক্ট পাস করান। মুরুব্বীদের ভাষ্যমতে, তাঁর এ পরিকল্পনা বাল্যকাল থেকেই ছিল। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রতিটি গ্রামে রাস্তাঘাট, যানবাহনের ব্যবস্থা তিনি উন্নত করেন।

তিনি পাকিস্তান গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে ফরিদগঞ্জ-হাজীগঞ্জ আসন থেকে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। পরে তিনি বহুবার ফরিদগঞ্জ থেকে এমপি হন। ধর্ম এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হন। সমাজ ও দেশের বিশাল খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি সবকিছুর উপর একজন বড় আলেম ও ওলী ছিলেন। যা দুআ করতেন অনেক দিন পরে হলেও তা বাস্তবায়িত হতে দেখা যেত।

হুজুরের পিতা শাহ মুহাম্মদ ইয়াসীন (রহ.) ১৯৩৭ সালে দেবীপুর গ্রামটি ইসলামপুর নামকরণ করতে ইচ্ছা করেন। বৃটিশ আমলে অনেক জায়গায় দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু স্বধর্মের ও অন্য ধর্মের কিছু লোক মামলা ও অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে এ ইচ্ছা পূরণে বাধা দেয়। হুযুর তখন তার উত্তরসূরিদের এ কাজ করার কামিয়াবীর জন্য দুআ করে ১৯৫০ সালে ইন্তেকাল করেন। এর বহু বছর পর তার দ্বিতীয় পুত্র মাওলানা এম এ মান্নান সাহেব ১৯৮৭ সালে এই গ্রামের নাম পরিবর্তনে সফল হন। দেবীপুর হয় ইসলামপুর।

হুযুর ছিলেন খুবই অমায়িক ও মানবতাবাদী বুযুর্গ ব্যক্তি। কোনো ধর্মের মানুষ তার থেকে নিরাশ হতো না। এলাকার সব মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। ঢাকায়ও শিল্পপতি ও মন্ত্রী হিসেবে তিনি শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ সকলকে প্রয়োজনের সময় প্রকাশ্য বা গোপনে সাহায্য করতেন। বড় বড় নেতা ও মন্ত্রী-এমপি চিকিৎসা বা মানবিক প্রয়োজনে হুযুরের কাছে আবেদন করলে হুযুর আমাকে দিয়ে অনেক টাকা-পয়সা তাদের নিকট পাঠাতেন। আমি ছাড়া আরও লোকজন এমনকি স্বয়ং হুযুর বহু বড় বড় মানুষকে সহায়তা করেছেন। হুযুর তার সহকর্মীদের নিয়ে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ব্যানারে সারাদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি জাতীয় স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষক ফেডারেশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের দস্তখত নিয়ে একই সাথে ১৬ হাজার এবতেদায়ী মাদরাসার অনুমোদন নেন। এছাড়াও শিক্ষকদের বহু দাবি আদায় করেন। আলিয়া মাদরাসার সকল উন্নতি ও সুবিধা হুযুরের নেতৃত্বেই হয়।

হুযুরের কাছে দেশি-বিদেশি কোনো মেহমান এলে তার আন্তরিক, অভিজাত ও রাজকীয় মেহমানদারী লাভ করে চিরদিনের জন্য তার আপনজনে পরিণত হতেন। হুযুরের মেহমানদারীর কোনো তুলনা হয় না। হুযুর অনেক বড় আলেম হওয়ার পাশাপাশি আকর্ষণীয় সুবক্তা ছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার আলোচনা শুনতে থাকত। তিনি বহু বছর আগে মহাখালী গাউছুল আজম মসজিদ কমপ্লেক্সের স্বপ্ন দেখেন। আমরা তখন এটি অসম্ভব মনে করতাম। কিন্তু একসময় এটি বাস্তবায়িত হয়। হুযুর দেখে গেছেন। এখানে জুমার আগে কয়েক বছর বয়ান করেছেন, যেগুলো ইসলামী জ্ঞানের ভাণ্ডার, আধুনিক জ্ঞান ও রাজনীতির দিকনির্দেশক।

হুজুর তার পিতার অসমাপ্ত কাজগুলি সম্পন্ন করে গেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান করে গেলেও আত্মপ্রচারের জন্য নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান করেননি। তিনি একজন দক্ষ ও কর্মঠ নেতা ছিলেন। সকাল ১০টা থেকে কাজ শুরু করে তাহাজ্জুৎ ও ফজরের নামাজ পড়ে সীমিত সময়ের জন্য তিনি ঘুমাতেন। তিনি নিজের জীবনে ইসলামকে গভীরভাবে ধারণ করতেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেমন পালন করতেন, তেমনি মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকদের বলতেন, পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করে ক্লাস রুমে যাবেন, যেন ছাত্ররা আপনাদের কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা পায়। বহু রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে হুজুরের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নেওয়ায় তার জ্ঞান বিদ্যাবত্তা ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা যায়। এলাকার মানুষ তাকে পীর মানতেন। পালকী দিয়ে তাকে নানান জায়গায় নেওয়া হতো। মানুষ তার দুআ ও পানিপড়া নিত। অনেকের আশা পূরণ হতো। বিপদে তিনি ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতেন। তিনি হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার মুক্ত ছিলেন। কাজের মানুষ, সঙ্গী-সাথী ও পরিচিত সকলের সাথে স্নেহ, মায়া-মমতার সম্পর্ক রাখতেন। আল্লাহ তাআলা হুযুরের জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এবং তার পরিবারকে হেফাজত করুন। হুযুর এবং তার সহধর্মীনি দুজনই মহাখালী গাউছুল আজম মসজিদের পাশে শেষ বিছানায় শুয়ে আছেন। আল্লাহ তাদের কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। তাদের রেখে যাওয়া সকল প্রতিষ্ঠান, ঐতিহ্য ও স্মৃতিকে কেয়ামত পর্যন্ত হেফাজত করুন।

লেখক: সংস্থাপন নির্বাহী, দৈনিক ইনকিলাব

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন