তখন আমি সৌদি আরবে। সৌদি বাদশার অতিথি হিসেবে রাজকীয় অতিথিশালায় অবস্থান করছি। শারীরিক অবস্থা চেকআপের জন্য তখন প্রতি ছয় মাস অন্তর আমাকে রিয়াদে কিং ফয়সাল হাসপাতালে যেতে হতো। সৌদি সরকারের বদান্যে চিকিৎসা বা চেকআপের এই সুযোগটুকু পাই। মধ্যপ্রাচ্য তথা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাথে আমার গড়া সুসম্পর্কের কথা সৌদিরা স্মরণ করে। বিশেষ করে কুয়েত যুদ্ধের সময় সৌদিতে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণের কথা ওরা ভুলে যায়নি। শুধু সরকার নয়, সৌদির সাধারণ মানুষও আমাকে মনে রেখেছে। সৌদিতে সফরকালে কোনো বাজারে গেলে বা দোকানে কোনো কিছু কেনাকাটার জন্য ঢুকলে ওরা চিনে ফেলে। সৌদিতে বাংলাদেশি সৈন্য প্রেরণের কথা স্মরণ করে। কিছু কেনাকাটা করলে আমার কাছ থেকে দাম নিতে চায় না। আমাকে ‘রইস-এরশাদ’ বলে সম্মোধন করে। রইস মানে রাজা। ওরা আরবিতে যা বলে তার অর্থ হলো তুমি আমাদের দেশের জন্য যা করেছ তা আমাদের মনে আছে। তোমার কাছ থেকে কোনো জিনিসের দাম নিতে পারি না। তোমার যা প্রয়োজন নিয়ে যাও। এসব কথা শুনে বিগলিত হই, মুগ্ধ হয়ে যাই ওদের কৃতজ্ঞতায়।
সেদিন মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণ করেছিলাম বলে সৌদিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্মান এবং কদর অনেক ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের জনশক্তি সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছে। সৌদি সরকার বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক সেখানে নিয়োগ করছে। জনশক্তি খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে সৌদি থেকে। এসব সম্ভব হয়েছে আমার একটি সিদ্ধান্ত থেকে। অথচ, দেশে সেদিন তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কেন আমি সৌদি আরবে সৈন্য পাঠাচ্ছি তার প্রতিবাদে সকল বিরোধী দল মিলে হরতাল করল। কিন্তু ভাগ্যের এই এমনই পরিহাস, সেদিন যারা সৌদিতে সৈন্য প্রেরণের বিরোধিতা করেছিলেন তারাই পরবর্তীতে সেই পদক্ষেপের সুফল ভোগ করছেন। সৌদিতে গেলে সব স্মৃতির কথা খুব মনে পড়ে। অসম্ভব ভালো লাগে। সৌদি সফরে পবিত্র মাটির স্পর্শে দেহ মনকে শুদ্ধ করে নেয়ার আনন্দ তো আছেই, সেই সাথে আরবীয়দের ভালোবাসাতেও সিক্ত হয়ে যাই।
সৌদি সফরের প্রতিদিনের মতো ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখের সকালটাও মধুর আতিথেয়তার অনুভূতিতে উপভোগ করছিলাম। এমন সময় ঢাকা থেকে ফোন পেলাম। আমার একান্ত সচিব খালেদের টেলিফোন। ও জানালো, মাওলানা মান্নান আর নেই। তিনি ইন্তেকাল করেছেন। হৃদয়বিদারক খবর। খানিকটা সময়ের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভাবতেই পারছিলাম না মাওলানা মান্নান আর নেই। জানালা পথে আমার দৃষ্টি চলে গেল আকাশের দিকে শূন্য-মহাশূন্যতা, যেখানে অবিরত ঘোষণা করে, একদিন সকলকেই এমনিভাবে শূন্যে মিলিয়ে যেতে হবে। মাওলানা মান্নানের জীবনের অস্তিত্ব আজ শূন্য। কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতি আর অসংখ্য অমর কীর্তি। সেই স্মৃতি আমাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে এলো। মাওলানা মান্নানের ইন্তিকাল সম্পর্কিত বিস্তারিত খবর জেনে নিলাম। সৌদি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একটি শোকবার্তার কথা জানালাম আমার প্রেসসচিব সুনীলকে। ওকে বললাম, আমার শোকবাণীটা পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিতে।
সেই শোকবাণীতে মনের শোক উপশম হচ্ছিল না। হৃদয়ের মাঝে জমে থাকা মাওলানার স্মৃতিগুলো আমাকে দারুণভাবে পীড়া দিচ্ছিল। মাওলানা অনেকদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। জীবন আর মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবধারিত পথেই তাকে পা বাড়াতে হলো। অখণ্ড মহাকালের কোলে নশ^র জীবন প্রতিনিয়ত শেষ হয়ে যাবার পথে অগ্রসর হতেই থাকে। সেই সারা হবার অনিবার্যতা জেনেও মানুষ সৃষ্টির উৎসবে মেতে থাকে। সেটাই হয়তো পরওয়ারদিগারের ইচ্ছা, তা না হলে তার সৃষ্টি হয়তো আরো সুন্দরের দিকে ধাবিত হতো না। মাওলানা মান্নানও জীবনের ধাপে ধাপে অনেক অমর কীর্তি সৃষ্টিতে ব্রতী ছিলেন। সব কথা যদি বাদও দেইÑ একটি কীর্তিই হয়তো তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে যাবে। আর তা হলো মাওলানা মান্নান তার জীবদ্দশায় নিজ খরচে পাঁচ হাজারেরও বেশি লোককে হজ করতে পাঠিয়েছেন। আর কোনো দিল-দরিয়া মানুষ এটা করতে পেরেছেন কিনা জানি না। মাওলানা মান্নানের এই কীর্তি নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার রেকর্ড বুকে স্থান পেয়েছে।
মাওলানা মান্নানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ক্ষমতা গ্রহণের পর। তার আগে তিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তার পিতা একজন পীর ছিলেন। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে তার মাজার আছে। মাওলানা মান্নানের সাথে একবার মাজার জিয়ারত করে এসেছি। মান্নান সাহেবের সাথে পরিচয়ের পর থেকেই তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা এবং আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার ইসলামী শিক্ষা ও পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সেই প্রথম পরিচয় থেকেই উপলব্ধি করেছিলাম যে, ইসলামের সেবায় তার মতো লোকের সহযোগিতা ও পরামর্শ আমার প্রয়োজন হবে। মাওলানা মান্নান দলে এলেন। আমার দল থেকে এমপি নির্বাচিত হলেন। আমি তাকে গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত করলাম। সঠিক কাজের জন্য উপযুক্ত লোক যাচাই-বাছাইয়ে আমার যে ভুল হয় না, মাওলানা মান্নান তার উদাহরণ। আমি ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব উন্নয়ন, সংস্কার ও সেবামূলক কাজ করেছি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্মীয় পদক্ষেপসমূহ। আমি ইসলামের সেবায় বেশ কিছু কাজ করেছি, সেগুলো আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না পারলে ওই কাজগুলো করা আমার পক্ষে কোনদিন সম্ভব ছিল না। হয়তো আল্লাহ এই দায়িত্ব পালনের জন্যই আমার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। আর তাই আমি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা, জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণাসহ অসংখ্য ধর্মীয় সেবামূলক কাজ করতে পেরেছিলাম। আজ মাওলানা মান্নানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেসব কাজের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে। কারণ, এই কাজগুলো করার আগে ধর্ম মন্ত্রী হিসেবে আমি মাওলানা মান্নানের সাথে আলাপ-আলোচনা করে নিতাম। তিনি আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইসলামী ধারায় ব্যাখ্যা দিতেন। তার ব্যাখ্যায় আমি আরো অনুপ্রাণিত হতাম। ধর্মীয় কাজ সম্পাদনে বেশি উদ্যোগী ও উদ্যমী হতাম। আমি ইসলামের সেবায় যেসব কাজ করেছি, তার মধ্যে কয়েকটির কথা উল্লেখ করতে চাই।
মসজিদ নির্মাণ একজন মুসলমানের জন্য পবিত্র কাজ। সেই ভাবাদর্শে আমি নিউমার্কেট মসজিদ, সাভার স্মৃতিসৌধ মসজিদ, পিডব্লিউডি মসজিদ, গোলাপ শাহ মসজিদ, বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাব মসজিদ নির্মাণ করেছি। মাওলানা মান্নানের একান্ত চেষ্টায় মহাখালীতে নির্মাণ করেছি গাউসুল আজম মসজিদ। এছাড়া জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, কাওরান বাজার শাহী মসজিদ, লালবাগ কেল্লার মসজিদ, ষাটগম্বুজ মসজিদ, লালবাগ জামে মসজিদ মিনার, দিলকুশা জামে মসজিদ এবং ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বহু স্থানে মসজিদ সংস্কার ও উন্নয়ন করেছি। আমিই বায়তুল মোকাররম মসজিদকে জাতীয় মসজিদ ঘোষণা করেছি। ইচ্ছা ও উদ্যোগ নিলে যে কোনো মহৎ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এই মসজিদের নকশা প্রণয়ন করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি আবুল হোসেন থাইরানি। এর তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন তার ছেলে টি থাইরানি। স্পেনের একটি বিখ্যাত মসজিদের ধারণার সাথে মিল রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই মসজিদের পুরো প্রকল্পটি ৮.৩০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু মূল নকশা অনুযায়ী এই মসজিদের অনেক কাজ অসমাপ্ত ছিল। আমি ক্ষমতায় এসে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। এর জন্য তিন কোটি টাকার অনুদান সংগ্রহ করেছিলাম ওআইসি থেকে। বাকি ২৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম সরকারি তহবিল থেকে। ফলে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন জাতীয় মসজিদ।
আমি প্রায়ই মাওলানা মান্নানকে বলতাম, ইসলামের সেবায় যা কিছু করা যায় সে ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দেবেন। তিনি সেই কাজটি অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সম্পাদন করতেন। মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারই অনুপ্রেরণায় আমি প্রথমবারের মতো ১৯৮৫ সালে দাখিলকে এসএসসি সমমান এবং ১৯৮৭ সালে আলিম শ্রেণিকে এইচএসসির সমান ঘোষণা করেছি। ১৯৮৯ সালের ১০ জুন মাওলানা মান্নান গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে আমার সংবর্ধনা সভা আয়োজন করেছিলেন। মাওলানা মান্নান ছিলেন ওই সভায় সভাপতি। সেদিন আমি অভিভূত হয়েছিলাম এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি দেখে। কমপ্লেক্সের জায়গা বরাদ্দ করেছিলাম আমি, আর নির্মাণে ব্যয়ের অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। তবে এই মসজিদ এবং কমপ্লেক্স নির্মাণের সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন মাওলানা মান্নান। তিনি উদ্যোগী না হলে ওখানে এই পবিত্র মসজিদটি হয়তো নির্মিত হতো না। তবে সব কিছু তো আল্লাহর ইচ্ছা। এখানে মাওলানা মান্নান ছিলেন উপলক্ষ। আল্লাহ তার মহতী লক্ষ্য সফল করেছেন। আজ তিনি সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়েছে।
মাওলানা মান্নান একবার চাঁদপুরে তার নির্বাচনী এলাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যেতে যেতে তিনি বলেছিলেন পত্র-পত্রিকা আপনার খবর সঠিকভাবে প্রচার করে না। আমি একটা পত্রিকা প্রকাশ করবো, সেখানে আপনার খবর সঠিকভাবে তুলে ধরবো। জনসভায় দাঁড়িয়েও তিনি পত্রিকা প্রকাশের ঘোষণা দিলেন। সত্যি সত্যি মাওলানা মান্নান তাই করলেন। তিনি প্রকাশ করলেন দৈনিক ইনকিলাব। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কর্মের মধ্যে ইনকিলাব প্রতিষ্ঠাও অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। তার সুযোগ্য সন্তান এ এম এম বাহাউদ্দীন আজ ইনকিলাবের কর্ণধার, সুদক্ষ সম্পাদক। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। পিতার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব এখন তার। মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠনকে তাকেই এগিয়ে নিতে হবে। মাদরাসার ওপর বারবার আঘাত আসে। দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে তখনো মাদরাসার ওপর ঢালাওভাবে দোষ চাপানো হয়েছিল। মাওলানা মান্নান শয্যাশায়ী ছিলেন। তিনি প্রতিবাদ করতে পারেননি। আমি সোচ্চার হয়েছিলাম। বলেছি, দরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অর্জনের প্রতিষ্ঠানের উপর ঢালাওভাবে দোষ চাপাবেন না। যারা দু’বেলা ঠিকমতো খেতেও পায় না, মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় যাদের চলতে হয় তারা কোনো ধরনের সন্ত্রাসের সাথে জড়িত হতে পারে না। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে, কোনো মাদরাসা জঙ্গী তৎপরতার সাথে কখনো জড়িত ছিল না।
মাওলানা যখন শয্যাশায়ী, তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছি। কষ্ট পেয়েছি তার শারীরিক অবস্থা দেখে। চিকিৎসার জন্য বাহাউদ্দীন তাকে বিদেশেও নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ওপারের ডাক যদি আসে, কে তারে ধরে রাখতে পারে! আমার দুর্ভাগ্য মাওলানা মান্নানের জানাজা কিংবা কুলখানি কোনোটাতেই শরীক হতে পারিনি বিদেশে ছিলাম বলে। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)
লেখক: সাবেক প্রেসিডেন্ট, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন