রফতানির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রেভেনা বন্দরে যাবে পণ্যবাহী জাহাজ। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপে পণ্য যাওয়ার এই সূচনা নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অগ্রগতির পরিচায়ক। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’ নামের একটি জাহাজ এসেছে। গত শনিবার জাহাজটি বন্দরের এনসিটিতে ভিড়েছে। আসার সময় এমভি সোঙ্গা চিতা ৯৪৫ টিইইউএস খালি কন্টেইনার এবং সাত টিইইউএস কন্টেইনারভর্তি ক্যাপিটাল মেশিনারি নিয়ে এসেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ সোমবার ৯৮৩ টিইইউএস কন্টেইনার পণ্য নিয়ে ছেড়ে যাবে বন্দর। পণ্যের মধ্যে ৯৮ শতাংশই থাকছে তৈরি পোশাক। ইতালির ক্রেতাদের পাশাপাশি আরো কয়েকটি দেশের ক্রেতাদের তৈরি পোশাকও তার মধ্যে থাকছে। এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর ইতালি থেকে ‘ক্যাপি ফ্লোরেন্স’ নামের একটি জাহাজ খালি কন্টেইনার নিয়ে পরীক্ষামূলক যাত্রায় চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় এবং পণ্যাদি নিয়ে ফিরে যায়। তার সফলতাই এমভি সোঙ্গা চিতার গমনাগমন সম্ভবপর করেছে। জানা গেছে, এখন থেকে মাসে দুটি জাহাজ এই নতুন বাংলাদেশ-ইটালি রুটে চলাচল করবে। পরে প্রয়োজনে আরো জাহাজ বাড়ানো হবে। মূলত ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি পোশাক রফতানি দ্রুত, সহজ, মসৃণ ও সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যেই এই জাহাজ চলাচলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের পোশাক রফতানির ৪০ শতাংশই হয়ে থাকে ইউরোপে। এখানকার উৎপাদক ও রফতানিকারক এবং ইউরোপের ক্রেতারা সঙ্গতকারণেই এই সরাসরি জাহাজ চলাচল ও পণ্যপরিবহনের সাফল্য কামনা করে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বেশি গভীরতার বড় জাহাজ বা মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে না। এ জন্য সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকার কলম্বো, মালয়েশিয়ার কেলং ও তিনডং পেলাপাস এবং চীনের কয়েকটি বন্দরের ওপর নির্ভর করতে হয়। ওইসব বন্দরে মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে থেকে ছোট ও মাঝারি জাহাজে করে পণ্য ভর্তি কন্টেইনার নির্দিষ্ট বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে বড় হাজাজে করে সেই কন্টেইনার নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে। এভাবে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়। এই প্রক্রিয়ায় রফতানিতে সময় বেশি লাগে, খরচও বেশি পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাকর পরিস্থিতি ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। জানা যায়, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপে যেতে অন্তত এক মাস সময় লাগে। পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি গেলে সময় লাগবে ১৫/১৬ দিন। অন্যদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহনে ভাড়া লাগে কমপক্ষে ১৬ হাজার ডলার। সরাসরি গেলে সেই ভাড়া হবে ১০ হাজার ডলার কিংবা তারও কম। অনেক সময় ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে মাদার ভ্যাসেল পাওয়া যায় না। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। এতে রফতানিকারকদের নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়, অতিরিক্ত খরচও বহন করতে হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে স্থান ও অবস্থান নিশ্চিত করতে রফতানিকারকদের বেগ পেতে হয়। লাভও অন্যান্য দেশের রফতানিকারকদের চেয়ে কম হয়। আমদানির ক্ষেত্রে সময় ও খরচ বেশি হয়। অন্যান্য ঝামেলা পোহাতে হয়। এতে স্বাভাবিক কারণেই আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি দাম যুক্ত হয়। প্রান্তিক ক্রেতা ও ভোক্তাদের সেই বাড়তি দাম কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হয়। আমদানি পণ্যের পরিবহন সরাসরি হলে আমদানিকারকরা যেমন অতিরিক্ত সময় ও খরচের বাগড়া ও ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে, তেমনি ক্রেতা-ভোক্তারা প্রতিযোগিতামূলক সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনে লাভবান হতে পারবে।
চট্টগ্রাম আমাদের প্রধান সমুদ্র বন্দর। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে না। বন্দর চ্যানলে যে পরিমাণ পানি থাকলে মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে, সেরূপ পানি নেই। মাদার ভ্যাসেলসহ সব ধরনের জাহাজ আসতে, ভিড়তে, মালামাল বোঝাই ও খালাস করতে পারে, এমন গভীর সমুদ্রবন্দর আমাদের নেই। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ চলছে। কবে তা ব্যবহারযোগ্য হবে, বলার উপায় নেই। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন বিদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর সহায়তা এড়ানো যাবে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের উদ্যোগ নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। এ উদ্যোগ সফল এবং লাভজনক হলে ইউরোপেই শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশেও তৈরি পোশাক রফতানি ও আয় বাড়বে। ওইসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। এ উদ্যোগের পূর্ণ সফলতা আমরা কামরা করি। একইসঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর দ্রুত নির্মিত হোক, সে প্রত্যাশাও করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন