কুয়াকাটায় বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে উজাড় করা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের হাজার হাজার গাছ। ৫০ থেকে ৬০ বছরের এসব পুরানো বড় বড় গাছ স্কুভিটার (ভেকু) দিয়ে উপড়ে ফেলছে। বনের গাছ উপড়ে ফেলে কেটে নেয়া হচ্ছে বনের মাটি। বনের ভেতর বড় বড় পুকুর বা দিঘি কাটা হয়েছে। বন ও পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করেই চায়না সিকো কোম্পানীর সাব ঠিকাদাররা বছর ধরে বন ধ্বংস করে আসলেও নির্বাক বনবিভাগসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ২০২১ সালের ১০ মার্চ গঙ্গামতি বিট কর্মকর্তা মহিপুর রেঞ্জ অফিস বরাবরে একটি অভিযোগপত্র দায়ের করার মধ্যদিয়ে তাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেছেন। নেয়া হয়নি কোনো আইনগত ব্যবস্থা। কুয়াকাটা ৪৮ নং পোল্ডারের গঙ্গামতি ও খাজুরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বন উজাড় করে এমন ধ্বংস যজ্ঞ চালানো দেখে হতবাগ স্থানীয়রা।
গত ১ বছরে পটুয়াখালী বিভাগের বন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় রেঞ্জ কর্মকর্তারা একাধিকবার পরির্দশন করে বন ধ্বংসের এমনচিত্র স্ব-চোখে দেখলেও নেয়া হয়নি কোনো আইনি ব্যবস্থা। বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার থেকে শুরু করে প্রকল্প প্রকৌশলীরা বলছেন বনবিভাগের সাথে সমন্নয় করেই তারা বনের ভেতর থেকে মাটি কাটছেন। প্রতিদিনই বনবিভাগের কর্মকর্তারা উপড়ে ফেলা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন এমনটাই বক্তব্য ঠিকাদারদের। ব্যবস্থা নিচ্ছি, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তাদের কথা শুনছেন না এমন দ্বায়সারা বক্তব্য দিয়েই তাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেছেন স্থানীয় বন কর্মকর্তারা।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না সিকো কোম্পানী ও বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ থেকে ৬ বছর ধরে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চলে আসছে। বেড়িবাঁধ সংস্কারের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেস্টনী গড়ে তোলা প্রকল্পের উদ্দেশ্য। উপকূলীয় এলাকার মানুষকে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে। সেখানে হচ্ছে এর উল্টোটা। বনের বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। বনের মধ্যে বড় বড় পুকুর এবং দিঘি কেটে মাটি নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বেড়িবাঁধে। এসব হচ্ছে বনবিভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায়। জানা গেছে, চায়না সিকো কোম্পানীর বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এরপর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ওই কোম্পানিটি কাজের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দুই দফায় সময় নিয়েছে। উক্ত বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুয়াকাটার ৪৮ নং পোল্ডারের খাজুরা ও গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের মধ্যে চারপাশে বন মাঝখানে বড় বড় দিঘি কাটা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও খাল কেটে মাটি নেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের সেøাভ থেকে প্রায় চারশো-থেকে পাঁচশো মিটার বনের ভেতর থেকে বন উপড়ে ফেলে মাটি নেয়া হয়েছে। এখনও চলমান রয়েছে এসব ধ্বংস যজ্ঞ। যেমন খুশি তেমন চলছে বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ।
বেড়িবাঁধ সংস্কারে মাটি বাহির থেকে কিনে সংস্কার কাজ করার কথা থাকলেও সাব ঠিকাদাররা বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বনের ভেতর থেকে মাটি নিয়ে ব্যবহার করছে বেড়িবাঁধে। বনের লবনযুক্ত পলিমাটির সাথে বালু যুক্ত এসব মাটি ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নাজুক বেড়িবাঁধ। স্থানীয়দের মতে এ বেড়িবাঁধ টিকসই হবে না। বেড়িবাঁধে বালু দিয়ে তার উপরে মাটির প্রলোভ দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের ডিজাইন ও নিয়ম বহির্ভূত কাজ করা হচ্ছে। এই কাজের তদারকি কর্মকর্তা প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলছেন ঠিকাদাররা ভালো নয়। তারা তাদের কথা শুনছেন না। রাতের আধাঁরে বালু দিয়ে কাজ করছে।
মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম জানান, বন উজাড় করে বনের ভেতর থেকে মাটি কেটে বেড়িবাঁধে ব্যবহারের বিষয়ে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা ২০২১ সালের ১০ মার্চ একটি লিখিত অভিযোগ তার কাছে দিয়েছেন। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে অবহিত করা হয়েছে। কোনো মামলা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা পেলে মামলা করা হবে।
এ বিষয়ে সবুজ বেস্টনী প্রকল্পের প্রকল্প প্রকৌশলী মো. মজিবুর রহমান জানান, গাছ উপড়ে ফেলে বনের ভেতর থেকে মাটিকাটার বিষয়ে তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে কাজ বন্ধ করে দেয়া হবে। অপরদিকে কাজের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে এসে প্রকল্পের সচিব, পরিচালকসহ একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে গেছেন। পরিদর্শন রিপোর্ট দিলে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন তারা।
এ ব্যাপারে পরিবেশ আইনবিধ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্নয়কারী লিংকন জানান, বন উজাড় করে বনের ভেতর থেকে মাটি নিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা বন ও পরিবেশ আইনে কোনভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংস করে বনের ভিতরে পুকুর বা দিঘি কাটা আইন বিরোধী কাজ। বনবিভাগ তাদের দ্বায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থন করে নৈতিকতা বিরোধী কাজ করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন