শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ভাঙন বদলে দিতে পারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত

ফেনী নদীকে আন্তর্জাতিক প্রমাণের চেষ্টা ভারতের : হুমকির মুখে মুহুরী সেচ প্রকল্প

মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, ছাগলনাইয়া থেকে | প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর মাঝখানে ইনটেক ওয়েলে বা কূপ খনন করে পাইপের মাধ্যমে সমঝোতার ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলন কর নিতে চাচ্ছে ভারত। পানি প্রবাহের ভারতীয় অংশে না করে নদীর মধ্যবর্তী স্থানে কূপ খননের প্রস্তাবনার বিষয়ে প্রকৌশলগত যথার্থতা খতিয়ে দেখতে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই ফেনী নদী পরিদর্শনে আসছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এদিকে প্রায় ৩৬টি পাম্প বসিয়ে ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে ভারতের পানি প্রত্যাহারের বিষয় সুরাহার আগে সমঝোতার ১.৮২ কিউসেক পানি দেয়ার ব্যাপারে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, আশির দশকের পর বিভিন্ন সময়ে ভারত ত্রিপুরার সাবরুমের নানা স্থানে আর্ন্তজাতিক সীমান্ত আইন লংঘন করে শূন্য রেখা হতে দেড়শ’ গজের মধ্যে প্রায় ৩৬টি শক্তিশালী পাম্প মেশিন বসিয়ে ফেনী নদী থেকে একতরফাভাবে পানি তুলে নিচ্ছে। এ পাম্পগুলোর প্রতিটির ন্যূনতম ক্ষমতা দুই কিউসেক। এ হিসেবে ৩৬টি পাম্প মেশিনে চুক্তি ছাড়াই ৭২ কিউসেক পানি নিচ্ছে তারা। যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৪তম বৈঠকে সাবরুম শহরের মানুষের খাবার পানি সরবরাহের জন্য ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের সিদ্ধান্ত ছিল। ২০১২ সালে কারিগরি কমিটির বৈঠকে ৭টি শর্তসাপেক্ষে খাবার পানি সরবারহের জন্য ‘লো লিফট’ পাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে ঢাকায় সচিব পর্যায়ের বৈঠক বাংলদেশ এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৫ অক্টোবর ভারতে শীর্ষ বৈঠক ১.৮২ কিউসেক পানি তুলে নেয়ার বিষয়ে একটি যৌথ সমঝোতা স্মারক সই হয়।
জানা যায়, সমঝোতা অনুযায়ী ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি তুলবে ভারত, যার পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ৫২ লিটার এবং দিনে প্রায় ৪৫ লাখ লিটার। ফেনী নদীর মাঝখানে কূপ খননের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নেয়ার জন্যই এ প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পুনরায় স্থানটি পরিদর্শনে আসবে। সমঝোতা স্মারকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু’দেশের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা যৌথভাবে ইনটেক ওয়েলের (কূপ) স্থান চূড়ান্ত করবে।
রামগড়ের ভারপ্রাপ্ত ইউএনও উম্মে হাবিবা মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিনিধিদলটি নদীর বর্তমান পানি প্রবাহ, ইনটেক ওয়েল (কূপ) খননের সম্ভাব্য স্থান পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলেন, এটা ছিল প্রাক পর্যবেক্ষণ। চূড়ান্ত স্থান নির্ধারণ করার জন্য সপ্তাহ খানের মধ্যে জেআরসি’র উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল রামগড় আসবেন।
এদিকে ফেনী নদীর এক পাড়ে বাংলাদেশের অলিনগর, অন্য পাড়ে ভারতের আমলিঘাট। তবে অনেকটা শান্ত এই নদীর বাংলাদেশ অংশের অনেক এলাকায় নদীর পাড় ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে পাহাড়ি নদীর হঠাৎ স্রোত আর বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলন করাকে। কিন্তু নদীর প্রবণতা অনুযায়ী, একদিকে ভেঙে গেলে আরেকদিকে চর পড়তে শুরু করে। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সীমান্তের এই নদীর বাংলাদেশ অংশের পার ভেঙে যদি ভারত অংশে চর পড়তে শুরু করে, তাহলে হয়তো কোন কোন স্থানে সীমান্ত রেখাও পাল্টে যেতে পারে। সীমান্ত নদীর পেটে ফসলি জমি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি ইউনিয়ন শুভপুর ও চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার সীমান্তবর্তী অপর একটি ইউনিয়ন করেরহাট। দুই ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বয়ে যাচ্ছে ফেনী নদী, যার অন্যপাশে ভারত। গত কয়েক বছর ধরেই নদীর বাংলাদেশ অংশে ভাঙন হচ্ছে, এই বছর তা আরও তীব্র হয়েছে।
করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. এনায়েত হোসেন নয়ন বলছেন, নদীতে বালু তোলার জন্য যাদের ইজারা দেয়া হয়েছে, তারা অনুমতির চেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে ছোট ছোট মেশিন দিয়ে ইচ্ছামত বালু তুলছে। ফলে আমার ইউনিয়নের অনেক জায়গায় নদীর পাড় ভেঙে যাচ্ছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে ফেনী নদী, অভিন্ন নয়-শুধুই বাংলাদেশের সম্পদ। এর উৎপত্তি, প্রবাহ এবং ভৌগলিক অবস্থান নিশ্চিত করে ফেনী নদী কোনভাবেই আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহের সীমা রেখায় প্রবাহিত নয়। দেশি-বিদেশি যারাই ফেনী নদীকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করছেন বহু বছর ধরে, তারা কখনই মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেননি। সেখানেও তারা কোনভাবেই দু’দেশের অমিমাংসিত ভূমি নিয়ে কথা বলেন না। খাগড়াছড়ির ১৭শ’ একর অমিমাংসিত বাংলাদেশের যে ভূমির উপর দিয়ে এ নদী প্রবাহিত, তা ভারতের বলেই চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন অনেকে।
শুধু তাই নয়,পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও নিজেদের উত্তর-পূর্ব অংশের বেশ কটি রাজ্যের পানির অভাব মেটাতে দীর্ঘ বছর ধরে নানা কৌশলে ফেনী নদীকে আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরসরাই, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজীর মুহুরী সেচ প্রকল্প, ফুলগাজী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালী-লক্ষীপুরের কিছু অংশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানির জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে করে লাখ লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদের অনাবাদি হয়ে পড়বে। অকার্যকর হয়ে পড়বে ১৯৮৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদের হাত ধরে তৎকালীন ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরী সেচ’ প্রকল্প। যার আওতায় এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ থেকে ১৫টি উপজেলার ৮-৯ লাখ হেক্টর জমিতে লোনামুক্ত পানির সরবরাহ করা হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় যেখানে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস পাহালিয়া এ তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৮-৯ লাখ হেক্টর জমির সেচ কাজ করার কথা, সেখানে এখনই শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয়া সম্ভব হয় না। মুহুরী সেচ প্রকল্পের প্রায় ৮০ ভাগ পানির মূল উৎস ‘ফেনী নদী’। ফেনী থেকে ২৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-ফেনী জেলার সীমানায় মুহুরী সেচ প্রকল্পটির অবস্থান।
গণদলের চেয়ারম্যান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা, ফেনী নদীর পানি রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারী নেতা এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী জানান, ফেনী নদী বাংলাদেশের নদী। ৫৪টি অভিন্ন নদী ভারতের সাথে ১৯৭৫ সালে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সে ৫৪ নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম উল্লেখ ছিলো না। কিন্তু এ নদীর পানি ভারতকে দিয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি আঘাত হেনেছে। জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে আমাদের সরকার। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ফেনীসহ অত্র অঞ্চলকে মরুকরণের দিকে ধাবিত করছে। এ চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করে জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন