রফিকুল ইসলাম সেলিম : কর্ণফুলীর পানি পাচ্ছে বন্দরনগরীর বাসিন্দারা। বহু প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী প্রকল্প থেকে শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলক পানি সরবরাহ। দীর্ঘ ২৯ বছর পর বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ১৯৮৭ সালে মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্পের পর বড় প্রকল্প হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। দীর্ঘ তিন দশক শুধুমাত্র ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে নগরবাসীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে ওয়াসা। ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মহানগরীতে পানি সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
মহানগরীর বর্তমান জনসংখ্যা ৬০ লাখ। ওয়াসার হিসেবে নগরীতে বর্তমানে পানির দৈনিক চাহিদা ৫০ কোটি লিটার। ওয়াসা সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে মাত্র ২০ কোটি লিটার। প্রতিদিন ৩০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় এ সংকট থেকে নগরবাসী কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে এমন প্রত্যাশা ওয়াসা কর্মকর্তাদের। খুব শিগগির প্রকল্পটি পুরোদমে চালু হলে নগরীতে দৈনিক আরও ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দেয়া যাবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে চলছে পানি সরবরাহের কাজ। প্রাথমিকভাবে নগরীর আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
কর্ণফুলী নদীর পানি পরিশোধন করে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। সেখান থেকে পাইপ লাইনে পানি জমা করা হচ্ছে নগরীর নাসিরাবাদে রিজার্ভারে। সেখান থেকে মহানগরীতে পানি সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। জানা যায়, এ প্রকল্পে গতকাল থেকে শুরু হয় পরীক্ষামূলক পানি সরবরাহের কাজ। আগ্রাবাদ হালিশহর এলাকার গ্রাহকরা অতিরিক্ত পানি পাচ্ছেন গতকাল থেকে। আগে এসব এলাকায় সপ্তাহে দু’দিন রেশনিং করে পানি দেয়া হতো। পরীক্ষামূলকভাবে পানি সরবরাহ চালু হওয়ায় প্রতিদিন পানি মিলবে এমন প্রত্যাশা গ্রাহকদের।
কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী জহুরুল হক ইনকিলাবকে বলেন, পরীক্ষামূলক পানি সরবরাহ শুরু হয়ে গেছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কর্ণফুলী প্রকল্পে ৫০ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, নভেম্বরের মধ্যেই পুরোদমে উৎপাদন শুরুর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আর তখন নগরীতে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দেয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকায় এসব পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে নগরীর অন্যান্য এলাকায়ও পানি সরবরাহ দেয়া হবে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় মহানগরীর অপেক্ষাকৃত উঁচু ও দূরবর্তী এলাকায় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। কর্ণফুলী প্রকল্পের পানি যোগ হওয়ায় পানি সরবরাহ বেড়েছে।
এর ফলে যেসব এলাকায় পানি সংকট ছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে নগরীর টাইগারপাস, নিউমার্কেট, কোতোয়ালী, সিরাজুদ্দৌল্লা রোড, আন্দরকিল্লা, জামালখান, চকবাজার, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর এলাকায় পানি সরবরাহ বাড়ানো হবে। এরপর ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, চশমা পাহাড়, রহমান নগর, বায়েজিদ, হামজারবাগ, মোহাম্মদপুর, বিবিরহাট, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, রৌফাবাদ, অক্সিজেন এলাকায়ও সরবরাহ বাড়বে। প্রকল্পের উৎপাদন শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।
ওয়াসা সূত্র জানায়, দৈনিক ১৪ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। জাপানের জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পের অধীনে ৬৯ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন এবং তিনটি জলাধার নির্মাণ করেছে ওয়াসা। রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকায় ৩১ দশমিক ৫৫ একর জায়গায় পানি শোধনাগার ও ইনটেক ফ্যাসিলিটিজ এবং পোমরার অদূরে নোয়াগাঁও মৌজায় ১ দশমিক ৭১ একর ভূমিতে প্রকল্পের ইনটেক স্ট্রাক্টচার নির্মাণ করা হয়।
১৯৮৭ সালে মোহরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরপর কর্ণফুলী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন এখন শেষ পর্যায়ে। দীর্ঘ ২৯ বছর বড় কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মোহরায় একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ সময় বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।
এদিকে মদুনাঘাটে আরও একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রকল্পটি চালু হলে নগরীতে ৯ কোটি লিটার পানি সরবরাহ বাড়বে। ভান্ডার-জুড়ি প্রকল্প নামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আরও একটি পানি শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াসার। এ শোধনাগার থেকে পাওয়া পানি নগরীর দূরবর্তী বোয়ালখালী, আনোয়ারা এলাকায় গড়ে উঠা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২০২১ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানি সংকট পুরোপুরি কেটে যাবে বলে প্রত্যাশা ওয়াসা কর্মকর্তাদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন