শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আত্মহত্যা ও সংসার ভাঙার আগে ভাবতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

দেশে পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ আত্মহত্যা এবং সংসার ভাঙ্গার মতো ঘটনা হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যার কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে, দেশে ক্রমাগত এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার মধ্যে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারী-পুরুষ রয়েছে। সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। গত বছর করোনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৮ হাজার ৪৬২ জন। অন্যদিকে, আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। আত্মহত্যার প্রধানতম কারণ হিসেবে হতাশা বা জীবনের প্রতি আশাহীনতা ও বিতৃষ্ণাকে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন। এই হতাশা নানাবিধ কারণে মানুষের মনে জাগে। এর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সম্মানহানি, সংসারের টানাপোড়েন, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, একাকিত্ব। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও বাড়ছে। গত সপ্তাহে চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান লাইভে এসে ঘোষণা দিয়ে নিজ পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি আত্মহত্যা করেন বলে জানা যায়। তার আত্মহত্যার ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। এতদিন মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করার কথা শুনেছে। স্বচক্ষে দেখেনি। এবার অনেকে কারো আত্মহত্যার দৃশ্য দেখল। এমন মৃত্যুদৃশ্য কোনো স্বাভাবিক ও মানবিক মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। উচ্চ আদালত পরদিনই আত্মহত্যার এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দ্রুত সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। তারপরও অনেকে এ দৃশ্য দেখেছে। এ ঘটনার ঠিক আগের দিবাগত গভীর রাতে আমার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে। অপর পাশ থেকে এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক উৎকণ্ঠিত হয়ে জানায়, ফেসবুক লাইভে এসে এক অভিনেতা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। খবরটি শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। ও আমাকে ফেসবুক খুলে দেখতে বলে। আমার পক্ষে এমন দৃশ্য দেখা সম্ভব নয় বলে ফেসবুক খুলিনি। কেবল ভাবতে লাগলাম, এতক্ষণে মনে হয় সব শেষ হয়ে গেছে। মনের কী পরিস্থিতি হয়েছিল, তা বোঝানো সম্ভব নয়। সবাই তার আত্মহত্যার প্রস্তুতির দৃশ্য দেখছে, অথচ শত চিৎকার চেঁচামেচি করেও থামাতে পারছে না। গভীর রাতে তার বাসায় ছুটে যেতে যেতে দেখা যাবে, সে আর নেই। এমন এক অসহায় পরিস্থিতি। পরদিন অনুজপ্রতিম সাংবাদিক জানাল, তাকে বাঁচানো গেছে। কিভাবে বাঁচানো গেছে বর্ণনা দিয়ে বলল, ওর বাসার কাছাকাছি থাকে এমন সাংবাদিকদের ফোন করে তার বাসায় যেতে বলা হয়। পাশাপাশি ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়। তারা দ্রুত বাসায় গিয়ে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করে। এর মধ্যে যে ঘটনাটি ঘটে তা হচ্ছে, অভিনেতা তাদের যাওয়ার আগেই ফ্যানের সাথে ডিশ লাইনের তার প্যাঁচিয়ে গলায় বেঁধে ঝুলে পড়ে। তবে তার পিছলে ফ্যান থেকে খুলে যাওয়ায় সে মাটিতে পড়ে যায়। তখনই সাংবাদিক ও পুলিশ গিয়ে হাজির হয়। অভিনেতা আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিতে নিতে যে কারণের কথা উল্লেখ করে তা হচ্ছে, তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এটা সহ্য করতে না পেরে আত্মহনণের পথ বেছে নিচ্ছে। তার পারিবারিক কলহের আরও অনেক কথা বলে। পরবর্তীতে তার শুভাকাক্সিক্ষরা তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে মানসিক সান্ত¦না দিয়ে স্বাভাবিক করে। এখন সে ভালো আছে। মানুষের জীবনে ক্ষোভ-দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, দুঃসময় থাকবেই। কোনো সমস্যায় পড়লে তা যে চিরস্থায়ী হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। এ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। দুঃসময়কে বয়ে যেতে দিতে হয়। তার পরিবর্তে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং তা সমাধানেরও পথ নয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, তোমরা ধৈর্য্য ও প্রার্থণার মাধ্যমে সাহায্য কামনা করো। নিশ্চয়ই, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন (সুরা বাকারা ২:১৫৩)।’ এ কথার মর্মার্থ হচ্ছে, বিপদ-আপদ আসতে পারে। তাতে ধৈর্য্যহারা হলে চলবে না। ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সুনিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ সময় আল্লাহ তার সাথে থাকেন।

দুই.
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ আল্লাহর তরফ থেকেই আসে, মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। মন্দ কাজের ফল মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ভোগ করে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় ধৈর্য্য ধারণ এবং আল্লাহর সমীপে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমে। বিশ্বাসীদের বুঝতে হবে, তার জীবনের মালিক একমাত্র আল্লাহ। পৃথিবীতে সে নিজের ইচ্ছায় আসেনি। আল্লাহর ইচ্ছায় এসেছে। মানুষ তার জীবন এবং মৃত্যুর মালিক নয়। যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, ততক্ষণ সে পৃথীবিতে বিচরণ করবে, বেঁচে থাকবে। যখন তিনি মনে করবেন প্রয়োজন নেই, তখন মৃত্যু দেবেন। এর বাইরে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু নেই। যারা বিশ্বাসী, তাদের আল্লাহর এ বিধান মেনে চলতে হয়। ফলে আত্মহত্যার অধিকার তার নেই। আত্মহত্যা মানে খুন করা, যা মহাপাপ। বিপদ এলে বা অসুস্থ হলে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ধৈর্য্য ধারণ এবং একান্তচিত্তে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। বুদ্ধিমান ও বিশ্বাসীরা বিপদে আল্লাহর কাছেই ধর্ণা দেয়। মন যত অস্থির ও অস্থিতিশীল থাকুক না কেন, তার মধ্যেই আল্লাহর দরবারে প্রার্থণায় নিয়োজিত করতে হবে। ধৈর্য্য ধরে প্রার্থনা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, সবকিছু ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে যাবে। আল্লাহ মানুষকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন, সে তাঁর সাহায্য কামনা করে কিনা। সাহায্য কামনা করলে তিনি সাড়া দেন। মনে রাখা দরকার, আল্লাহর কাছে কোনো দোয়াই বিফলে যায় না। আর আল্লাহ যে সাহায্য করেন, তা স্থায়ী। আবার আল্লাহ বিপদ দেন তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের দোস্ত।’ কথাটি শুনতে সাধারণ মনে হলেও এ কথার মর্মার্থ যে কত বড়, তা গভীরভাবে চিন্তা না করলে বোঝা যাবে না। তিনি মহাপবিত্র, মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাবান এবং একমাত্র ত্রাতা। সেই তিনি যখন বলেন, আমি তোমাদের দোস্ত, তখন আর কারো কি প্রয়োজন আছে? তিনিই তো যথেষ্ট। বিপদে পড়লে মানুষ সাধারণত তার বন্ধু-বান্ধবের কাছে সহযোগিতা বা পরামর্শ নেয়ার জন্য ছুটে যায়। আর যেখানে আমাদের স্রষ্টা এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের মালিক আল্লাহ বলছেন, আমি তোমার বন্ধু, সেখানে তার কাছেই তো সবার আগে ছুটে যাওয়া জরুরি। তিনি ছাড়া আর কে সাহায্য করতে পারে? এই যে, একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা এবং হতাশার কারণে লাইভে এসে রিয়াজের শ্বশুর আত্মহত্যা করলেন, এটা মোটেও উচিৎ হয়নি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘মোমেন কখনো হতাশ হয় না বা দুঃশ্চিন্তা করে না।’ রিয়াজের শ্বশুর যে অফুরন্ত একাকী সময় পেয়েছিলেন, এ সময়টি ছিল মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ। এ সময়টিতে যদি তিনি এবাদত-বন্দেগী ও বাংলা অর্থসহ কোরআন পড়তেন, তাহলে তার মনে আত্মহত্যার চিন্তা কোনোদিনই আসত না। তিনি এ ধরনের চিন্তা করার সময়ই পেতেন না। কোনো ধর্মই আত্মহত্যা সমর্থন করে না। বরং ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে জীবনযাপনের সকল পন্থার কথা বলা হয়েছে। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। যার অঢেল আছে, সে আরও চায়। এই চাইতে গিয়েও তার মধ্যে হতাশা জন্ম নেয়। চাইতে চাইতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এমনকি তার স্ত্রী-সন্তানও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে যার মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে পড়ে। যাদের জন্য এত কিছু করা সেই তারা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও নিজেকে একা মনে করে। তখনই কারো কারো কাছে জীবন অর্থহীন মনে হয়। আবার অনেকে চরম অভাব-অনটনে থেকেও জীবনযাপন করে। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মিল খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশা থেকে নিজের জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই উভয় ক্ষেত্রেই কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে যদি তারা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি মনোযোগী হয়, তাহলে তাদের দুঃখ-কষ্ট বলে কিছু থাকবে না। তাদের মধ্যে এ বোধ থাকতে হবে, আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু নেই। চেষ্টা করার পরও তিনি আমাকে যেভাবে রেখেছেন, সেভাবেই আমাকে থাকতে হবে এবং শুকরিয়া আদায় করতে হবে। কারণ, রিযিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, তিনি সর্বোত্তম সহায্যকারী, উত্তম রিযিকদাতা। তিনি যাকে খুশি তাকে রিযিক বাড়িয়ে দেন, যাকে খুশি রিযিক কমিয়ে দেন। যাকে খুশি তাকে রাজা বানিয়ে দেন, যাকে খুশি তাকে ফকির বানিয়ে দেন। আবার তিনি এ কথাও বলেছেন, তিনি প্রাচুর্যময়। তার কাছে কোনো কিছুর অভাব নেই। কাজেই, বিশ্বাসীদের এই একনিষ্ঠ বিশ্বাস থাকতে হবে, আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তাঁর প্রাচুর্য এবং নেয়ামত থেকে চাহিদা মতো চেয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটা বুঝতে হবে, আমাদের যা প্রয়োজন, তা তাঁর প্রয়োজন নেই। সবকিছুই তিনি আমাদের জন্য রেখেছেন। কাজেই তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধরতে হবে। পাশাপাশি সর্বাবস্থায় শুকরিয়া আদায় করতে হবে যে, তিনি যা দিয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট। এই চেতনা এবং চিন্তা মনে জাগ্রত রাখলে হতাশা, দুঃশ্চিন্তা ঠাঁই পাবে না এবং আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য চিন্তা মাথায় আসবে না।

তিন.
আমাদের দেশে এখন কথায় কথায় সংসার ভেঙ্গে দেয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের পক্ষ থেকেই ঘটছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি ডিভোর্সের আবেদন পড়ছে। দেশের অন্যান্য শহরেও এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, গ্রামের দিকেও এ হার বাড়ছে। সংসার ভাঙার আবেদনের কারণ হিসেবে সাধারণত গৎবাঁধা কিছু কথাবার্তা উল্লেখ থাকে। স্বামীর সাথে স্ত্রীর, স্ত্রীর সাথে স্বামীর বনিবনা হচ্ছে না, অমিল, ভরণপোষণ দিচ্ছে না ইত্যাদি। তবে সমাজবিদরা বলছেন, এর পেছনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, উচ্চাভিলাসী মনোভাব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব প্রভৃতি কারণ হয়ে রয়েছে। এসব কারণ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমাদের চিরায়ত পারিবারিক যে মূল্যবোধ তার চরম অবক্ষয় চলছে। আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি হচ্ছে, সংসারে যতই সমস্যা থাকুক না কেন, এসব সমস্যা মেনে সমাধানের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। পশ্চিমা বিশ্বের মতো নয়। উন্নত বিশ্বে সংসার গড়ে যতদিন মন চায় একসাথে থাকে, মন না চাইলে ভেঙ্গে দেয়। এতে সেসব দেশে পারিবারিক সংস্কৃতি এখন হুমকির মুখে। এ নিয়ে দেশগুলোর সরকারও চিন্তিত। কারণ, পরিবার হচ্ছে মানুষ গড়ার সুঁতিকাগার। একজন মানুষের সুষ্ঠুভাবে ও সভ্য হয়ে বেড়ে ওঠার মূল কারিগর পরিবার। যদি পরিবারই না থাকে কিংবা এর স্থায়িত্ব না থাকে, তাহলে সেই পরিবারের সন্তানদের সভ্য হয়ে বড় হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমাজও তাদের মূল্যায়ন করে না। সন্তানকে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র অপবাদ নিতে হয়। আমাদের দেশেও যেসব সংসার ভেঙ্গে গেছে বা সন্তানদের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটেছে, তাদেরকেও এই অপবাদ নিতে হচ্ছে। এতে সন্তানের মনে বিরূপ ধারণার জন্ম নেয়। নিজেকে সমাজচ্যুত ভেবে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এ থেকে সে বিপথে পা বাড়ায়। ফলে সংসার ভাঙা বা বিচ্ছেদের আগে স্বামী-স্ত্রী বা বাবা-মাকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। সমস্যার উদ্ভব ঘটলে তা কিভাবে ‘মিনিমাইজ’ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ চিন্তা মাথায় রাখতে হবে, সংসার হচ্ছে, ‘আর্ট অফ কম্প্রমাইজ’। এটা ভাবতে হবে, তাদের বিচ্ছেদের ফলে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সন্তানের জীবন। সন্তান কোন দিকে যাবে, কার দিকে যাবেÑএমন কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে পড়বে। বাধ্য হয়ে সে যদি বাবার দিকে যায়, তাহলে মায়ের জন্য এবং মায়ের দিকে গেলে বাবার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকবে। জীবনের শুরুতে কোনো সন্তান যদি এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন সে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। বিয়ে বিচ্ছেদের সাথে বাবা-মায়ের কারো মৃত্যুর তুলনা করা যাবে না। বাবা-মা জীবিত থাকতে বিচ্ছেদ হওয়া আর মৃত্যু এক কথা নয়। আবার যাদের সন্তান নেই তাদের বিচ্ছেদও উভয়ের জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের সামাজিক মর্যাদার অবস্থান ক্ষুন্ন হয়। মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। পারস্পরিক দোষারোপের স্বীকার হতে হয়। ইসলামে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাক স্বীকৃত। তবে একান্ত বাধ্য না হলে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনেও মহান আল্লাহ তালাকের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় তালাক দিতে হবে এবং তালাকপ্রাপ্তর অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পাশাপাশি এ কথাও বলে দিয়েছেন, তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ। আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি উন্নত বিশ্বের কাছে ঈর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পারিবার ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। পরিবারই যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে তা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তরুণ সমাজ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দেশটির তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপকহারে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়া নিয়ে পরিবার ভেঙ্গে যাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমাদের উচিৎ এশিয়ার দেশগুলোর মতো পারিবার গড়ে তোলা। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের পারিবারিক যে মূল্যবোধ, তাতে একজন মানুষকে সভ্য হয়ে গড়ে উঠতে উত্তম পন্থা হিসেবে কাজ করে। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো যখন আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতিকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিচ্ছে, তখন আমাদের পরিবারে ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের এবং দুঃখজনক।

চার.
আমাদের দেশে পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তারা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ছুটে চলেছেন। স্থাপত্যগত বা ইট-পাথরের উন্নয়নকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এসব উন্নয়ন যাদের জন্য, সেই মানুষই যদি অসুখী হয়ে পড়ে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে এ উন্নয়ন করে কি হবে? উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রথাগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে এখন মানুষের মানবিক ও সুখী করার নীতি অবলম্বন করছে। এ কারণে বিশ্ব সুখী দেশের তালিকা-২০২২ সালের শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ন্যাদারলেন্ডস, নরওয়ে, সুইডেন এমনকি ছোট্ট দেশ ভুটান। এ দেশগুলো মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস, মানবিকতা, পরস্পরের মধ্যে সামাজিক সহযোগিতা-সহমর্মীতা, সমতা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে এবং তা প্রতিষ্ঠা করে সুখী দেশে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা এসব বিষয় উপেক্ষা করে কেবল জিডিপি, মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কতটা উন্নতি করা যায়, এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভেতরে ভেতরে যে সমাজ ও পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে বেশি সময় লাগবে না। তখন অর্থনৈতিক কোনো উন্নতিই তা সামাল দিতে পারবে না। কাজেই সরকারের উচিৎ এখনই মানুষের সুখী হওয়ার সূচকের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া। আত্মহত্যা এবং পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া। মানুষের মধ্যে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়া।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৫:১০ পিএম says : 0
Without Quranic rule nothing will happen,,, we will face more severe problem.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন