ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম বিরোধী নানা অপতৎপরতা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি নতুন বা হঠাৎ করে জেগে ওঠা কোনো বিষয় নয়। দিল্লিতে ক্ষমতায় বসার আগে থেকেই বিজেপি অধ্যুষিত বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গায় শত শত মানুষের প্রাণহানি যে অশনিসংকেত দিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারই ধারাবাহিকতা চলছে। কখনো গো-রক্ষার নামে, কখনো এনআরসি আবার কখনো হিজাব পরার বিরুদ্ধে বিজেপির উগ্র গেরুয়া সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস চলছেই। বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে স্কুল-কলেজের মুসলমান শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার বিরুদ্ধে খোদ রাজ্য সরকারের বিতর্কিত ভূমিকায় সেখানকার মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ ও হতাশ হলেও রাজনীতি বা সামাজিক ময়দানে তার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। কিছুদিন আগে কর্ণাটকের উড়ুপি জেলায় একটি বিদ্যালয়ের ৬ মুসলিম শিক্ষার্থীকে হিজাব পরার কারণে বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। রাজ্যজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে এ ঘটনার বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার মধ্যেই মান্ডিয়া জেলার পিইএস কলেজের শিক্ষার্থী মুসকান নিজে কলেজ ক্যাম্পাসে হিজাব পরে প্রবেশ করায় শত শত গেরুয়া র্স্কাফধারী ব্যক্তি ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিয়ে তার পথরোধের চেষ্টা করে। গেরুয়াধারীদের জয় শ্রীরাম শ্লোগানের বিপরীতে মুসকান একাই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। এর ভিডিওটি সারাবিশ্বে ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে এটি একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদীদের আরোপিত বিতর্কিত বিষয়গুলো ভারতের মুসলমানদের জন্য ঈমান-আক্বিদা ও অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু মুসলমানদেরই সংকটে ফেলছে না, ভারতের সংবিধান এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে কলুষিত করে আদতে ভারতকেই দুর্বল ও অস্থিতিশীল করে তুলছে। কর্ণাটকে গেরুয়াধারীদের হিজাব বিরোধী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একা রুখে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী এখন সারাবিশ্বে প্রতিবাদের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিও’র ধারাবাহিকতায় সে এখন ‘পোস্টার গার্ল’ বলে আখ্যায়িত হচ্ছে। ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির ধ্বনি এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ ভাইরাল হ্যাশট্যাগ। হিজাব বিরোধিতার নামে গেরুয়াধারীরা মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে বলে সেই শিক্ষার্থী মুসকান তার এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই গেরুয়াধারীদের হিজাব বিদ্বেষের প্রতিবাদ এবং মুসকানের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। হিজাব বিরোধিতার নামে মুসলমানদের শিক্ষায় প্রান্তিককরণের অভিযোগ তুলেছেন মালালা। একইভাবে ভারতের কংগ্রেস নেত্রী, তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক আইডল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও মুসকানের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। হিজাব বিতর্কের জেরে কর্ণাটকের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
আগামী বছর রাজ্য পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হিজাব বিরোধিতা করে গেরুয়াধারীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু ভোটারদের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে চাইছে। অন্যদিকে ভারতের তথাকথিত সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বলে দাবিদার শ্রেণিটি কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের এই নীরবতা ভারতের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। কর্ণাটকের ঘটনা সারাবিশ্বে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠলেও মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা এখনো অস্বচ্ছ ও অনভিপ্রেত। বছরের পর বছর ধরে ভারতের মুসলমানরা কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা নিগৃহীত ও চরম হিংসার সম্মুখীন। বিশ্বের অন্যতম বৃহত মুসলিম জনগোষ্ঠির এ অবস্থায় ওআইসিসহ মুসলমান দেশগুলোও নীরব। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, ভারতের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষে তাদের ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানের নাগরিক নিরাপত্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। জাতিসংঘও চোখ-কান বন্ধ করে আছে। পশ্চিমা দেশও তাই। অথচ, মুসলিম কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের পান থেকে চুন খসলেই তাদের ঘুম হারা হয়ে যায়। এর চেয়ে দ্বিমুখী নীতি আর কী হতে পারে! আমাদের দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল ও নারীবাদীদের নীরবতাও লক্ষনীয়। অথচ, এখানে হিন্দু মন্দিরে কেউ ঢিল ছুঁড়লেও তারা সমস্বরে হই হই করে ওঠে। এমনকি বিদেশি মিশনের কর্মকর্তারাও অকুস্থলে ছুটে যান, বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে মাঠ গরম করেন। ভারতের গেরুয়াধারীদের মুসলিম বিদ্বেষ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানের সোচ্চার হওয়া উচিত, ন্যায়সঙ্গত বক্তব্য আসা উচিত। বলাই বাহুল্য, গেরুয়াধারীদের হিজাব বিরোধিতার কারণে হিজাবের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে এর বিপরীত চিত্রই দেখা গেছে। শত শত গেরুয়াধারীর আক্রমণের বিরুদ্ধে একজন সাহসী মুসকানের প্রতিবাদী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি ভারতসহ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের অন্তরকে জাগ্রত করেছে। ভারতের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন