রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৯ এএম

ইলমে হাদীসের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বহু উস্তাদের উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান চিরদিনের মতো এই নশ^র জগৎ থেকে চলে গেলেন। মুহাদ্দিস ছাহেব বলে খ্যাত এই বুর্যুগ্ গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সোমবার সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে সিলেটের জকিগঞ্জস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিশাল জানাজাজামাত শেষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশের্^ তাঁকে দাফন করা হয়। পরম পরিতাপের বিষয়, এর মাত্র সপ্তাহখানেক আগে তার সহধর্মিনীও দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন।

আল্লামা হবিবুর রহমান যেমন ছিলেন ইলমে শরীয়তের প্রখ্যাত আলিম, তেমনি ছিলেন ইলমে মারিফতেরও শায়খে কামিল। তিনি ছিলেন ছাহেব কিবলা ফুলতলী আল্লামা আবদুল লতীফ চৌধুরী রহ. এর অন্যতম খলীফা এবং বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ-এর সাবেক সভাপতি। বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন-ইতিহাস। অত্যন্ত মেধাবী এই মনীষী ছাত্র হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, মুহাদ্দিস হিসেবে, প্রিন্সিপাল হিসেবে, মুবাল্লিগ-ওয়ায়েজ হিসেবে, বিভিন্ন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, কোর্টের বিচারক হিসেবে প্রখর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেশে এবং বিদেশে রয়েছে তাঁর অগনিত গুণগ্রাহী, ভক্ত, অনুগামী ও অনুসারী।

আল্লামা হবিবুর রহমানের জন্ম সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামে, ১৯৩৪ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন এলাকার প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন মাওলানা মুমতায আলী রহ.। পড়ালেখা শুরু করেন তিনি সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদরাসায়। এখানে অধ্যায়ন করেন তিনি মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। এরপর গাছবাড়ী জামিউল উলুম মাদরাসায় পড়ালেখা করেন এবং সেখান থেকে ১৯৫৫ সালে আলিম, ১৯৫৭ সালে ফাযিল ও ১৯৫৯ সালে হাদীস বিভাগে কামিল পাশ করেন। তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের প্রতিটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৯ সালে তিনি ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় শুরু করেন শিক্ষাকতা। ১৯৬৩ সালে তিনি সৎপুর দারুল হাদীসে প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৭৪ ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় তাঁকে প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়। সেখানে যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে প্রথমে উম্মুল কুওয়াইন নামক শহরের একটি জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব নিযুক্ত হন। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত উম্মুল কুওয়াইন কোর্টে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আবার তাঁর পুরাতন কর্মস্থল ইছামতি মাদরাসায় প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে অত্যন্ত সুনাম-সুখ্যাতি ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ঐ তারিখেই তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন এ দায়িত্ব থেকে।

মাদরাসার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ইলমে হাদীসের খিদমত থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হননি কখনও। হাদীসের প্রচার, দরস-তদরীস, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান, ওয়াজ নসীহত, তরিকতের তালিম ও তলকীন জারি রেখেছেন আজীবন। এমন কি মৃত্যুসজ্জায় শায়িত অবস্থাতেও তিনি আগ্রহী প্রার্থীদের সবক দিয়েছেন, সনদ দিয়েছেন, নসীহত করেছেন। তাঁর জীবন ছিল দ্বীনের জন্য কুরবান। ইলমী তাজকিরা থেকে তিনি বিরত থাকেননি কখনও। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বসচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ। আমি (নিবন্ধ লেখক) দেশে ও বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে তাঁর সাথে অনেক সফর করেছি, মাহফিলে-মজলিসে যোগদান করেছি। এ সময়ে কখনো দেখিনি তাঁকে গাল-গল্প করে সময় নষ্ট করতে। কারো সমালোচনা করতে বা কারো বিরুদ্ধে মন্দবাক্য উচ্চারণ করতে শুনিনি। তিনি ছিলেন উদার, মহৎ ও সবার কল্যানকামী। তিনি যেমন নিজে বেশকিছু দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছেন তেমনি এসব কাজে অপরকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন সকল কাজে সুন্নতের পাবন্দ। তিনি বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া, মরক্কো, ভারত, সৌদি আরব সফর করেছেন। সে সব দেশের মশহুর মুহাক্কিক উলামা-মাশায়িখদের সাথে বৈঠক করেছেন, ইলমী আলোচনা করেছেন, হাদীসের সনদ আদান-প্রদান করেছেন।

১৯৯১ সালে তাঁর সম্পাদনায় সিলেট থেকে ‘মাসিক শাহজালাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিভিন্ন দ্বীনী কিতাব প্রণয়ন করে গেছেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে আল কাউলুল মাকবুল ফী মীলাদির রাসূল, দোয়ায়ে মাসনুনা ও তেত্রিশ আয়াতের ফযীলত, মাসআলায়ে উশর: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, দুরূদ শরীফের ফযীলত ও ওযীফা, যিয়ারতে মদীনা মুনাওয়ারা (ফযীলত ও নিয়ম), আসহাবে বদর, ওযীফা, হজ্জ ও যিয়ারত (সংক্ষিপ্ত আহকাম ও নিয়ম), হাদীয়াতুল লাবীব ফী নাবযাতিম মিন সীরাতিন নাবিয়্যিল হাবীব, যাখীরাতুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী ফাদায়িলি সায়্যিদিল মুরসালিন, কানযুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যিল আমীন, তুহফাতুল লাবীব ফী আসানীদিল হাবীব, আত তুহফাতুল লাতীফাহ ফী আহাদীসিল মুসালসালাতিল মুনীফাহ, দালাইলুল খাইরাত (তাহকীক ও বিন্যাস) ও আল হিযবুল আযম (তাহকীক), সীরাতে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইত্যাদি। প্রায় ষাট বছর ধরে ইলমে হাদীসের খিদমতে নিরলসভাবে নিয়োজিত ছিলেন এই মনীষী। তিনি হাদীস শরীফের যে দরস দিয়ে গেছেন তা এক অমূল্য সম্পদ। আশার কথা, বিক্ষিপ্ত সে দরসসমূহ সংকলিত করে ‘দরসে হাদীস’ শিরোনামে প্রকাশনার কাজ শুরু করে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন ও সুলেখক মাওলানা আবদুল আউয়াল হেলাল। ইতোমধ্যে এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়েছে ‘আল হাবীব ফাউন্ডেশন’ থেকে। তিনি মুহাদ্দিস সাহিব প্রণীত বেশ কিছু আরবি গ্রন্থের সফল অনুবাদও করেছেন। ‘দরসে হাদীসে’র এ খিদমতটিও তিনি চালিয়ে যাবেন বলে আমরা আশা করি। মুহাদ্দিস সাহিব আজ নেই, তাঁর অনেক কৃতী ও স্মৃতি এখনও বিদ্যমান। এগুলো সংকলন করা, সংরক্ষণ করা, সম্প্রসারণ করা তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীদের কর্তব্য। আল্লাহ তাঁদের তাওফীক দান করুন এবং মুহাদ্দিস হুজুরকে দান করুন জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Tanvir Saki Bhuiyan ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৪৭ এএম says : 0
Inna lillahi owa inna ilaihi rajiuon.. Ameen..
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন