ইসলাম শব্দটি মুখে আসলেই মনের কোণে একধরনের প্রশান্তির নহর জারি হয়। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, ‘ইসলাম’ শব্দটি ‘সালাম’ শব্দমূল থেকে নির্গত। সালাম অর্থ শান্তি। ঘোর তিমিরে দীপশিখার নাম ইসলাম। সর্বযুগের সর্বাধুনিক জীবনব্যবস্থার নামই ইসলাম। ইসলাম মানুষকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। নারী ও পুরুষের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। অবস্থালোকে উভয়ের মাঝে শরীয়তের বিধানেও রয়েছে ভিন্নতা। লজ্জাস্থন হেফাজত করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আবশ্যকীয় বিধান। পবিত্র কুরআনের বাণী, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিনদের স্ত্রীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিংদাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)
নারীরা কাপড়ের একটি টুকরো মাথায় পরছে, আর তাতে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে তা পরতে আইন করা হচ্ছে; কোনো কোনো দেশ তা পরতে সাধারণ অনুমতি দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশে তা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু এ হিজাব কী? মুসলিম নারীরা কেন হিজাব পরছে? মুসলিম নারীদের পরা ছোট্ট এক টুকরো কাপড় ‘হিজাব’ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ওঠে আসছে কেন? আসলেই নারীর জন্য পবিত্রতার প্রতীক হিজাব। এটি নারীর প্রতি মহান আল্লাহর এক মহা নিয়ামত। তিনি প্রত্যেক ঈমানদার নারীর জন্য হিজাব পরাকে আবশ্যক করেছেন। ঈমানদার নারীরা আল্লাহর বিধান পালনে তা পরতে বাধ্য। এ হিজাব নারীর শালীন চলাফেরা ও নিরাপত্তার কার্যকর উপায়। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ঈমানদার নারীকে হিজাব পরতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না তাদের দেহের (বুকের) ওপর ফেলে রাখে’ (সূরা নূর: ৩১)।
নারীর জীবনমান ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষায় মহিলার জন্য পুরো শরীর আবৃত করা ফরজ। কেননা নারীরা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল এবং অসভ্য পুরুষের পাশবিক আচরণের মুখে অসহায়। তাই সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রগতি কোনো কিছুর দোহাই তাদের এসব পাশবিকতা থেকে রক্ষা করতে পারে না। এ জন্যই আল্লাহ পর্দার বিধান দিয়েছেন। নারীদের ইজ্জত-আব্রু রক্ষায় হিজাব ছায়াসঙ্গী। সামাজিক ও নৈতিক ক্ষয়-লয় এবং পতন-পঁচনের সমাজেও আমরা দেখছি, যেসব নারী পর্দার মধ্যে বেড়ে ওঠে তারা বখাটেদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকেন। সাধারণত পর্দানশীন নারীদের উত্ত্যক্ত করতে দুষ্টরা দ্বিধাবোধ করে। কোনো মুসলিম নারীরই উচিত নয়, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে নিজের জীবনের কল্যাণের উৎস নষ্ট করে দেওয়া। বেপর্দা হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনাবৃত রেখে কোনো মহিলা কোথাও জাগতিক স্বার্থ লাভ করে না। একান্তই শয়তানের প্ররোচনা অথবা অমুসলিম বা পরকালভোলা নারীদের অনুকরণের প্রবণতায় তারা এরূপ কঠিন হারামে লিপ্ত হয়।
হিজাব পরনে কারো জাগতিক কোনো ক্ষতি হয় না, কোনো কর্ম বা প্রয়োজন ব্যাহত হয় না, পারিবারিক-সামাজিক সম্মান বা মর্যাদায় ঘাটতি আসে না; বরং নারী অতিরিক্ত সম্মান-মর্যাদা লাভ করেন। আল্লাহর অফুরন্ত দয়া, কল্যাণ ও বরকত লাভেও ধন্য হন। ঈমানদার নারীদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। যদিওবা পর্দা বা হিজাব ইসলামী শরীয়তের অলঙ্ঘনীয় বিধান; তথাপি হিজাব আধুনিক সভ্যতারও পরিচায়ক। বিশ্বব্যাপী আধুনিকতার নামে নগ্নতাকে প্রমোট করে লাজ-লজ্জার মাথা খাওয়া নির্লজ্জ সভ্যতার বিরুদ্ধে ‘হিজাব আন্দোলন’ উত্তপ্ত মরুভূমিতে শান্তির ফোয়ারা। সমাজে আধুনিকতার নামে গায়ের ওড়না হয়েছে মাফলার বা ক্ষেত্রে বিশেষে ওড়নাই নেই। যত বেশি খোলামেলা পোশাক পরা যায় ততবেশি আধুনিক। এ আধুনিকতা মেয়েদের পণ্য বানিয়ে রেখেছে। টিভির বিজ্ঞাপনগুলোতে মেয়েদের চিত্র প্রদর্শনীই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাগাজিনের কভারে কোনো নারী মডেলের ছবি ছাপলেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। আর অন্যদিকে এ নগ্নতার মাধ্যমে আমাদের সমাজ হচ্ছে কুলষিত। দেহের এই সৌন্দর্য প্রদর্শনী নারীদের কতটুকু নিচে নামাচ্ছে তা যেদিন তারা বুঝবে; আফসোস করা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না। হিজাব বাস্তবেই মেয়েদের সম্মানকে সুনিশ্চিত করে। যেমন, রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া দু’টি মেয়ে; যাদের একজন হিজাব পরে ও অন্যজন খোলা চুল এলিয়ে আঁট-সাঁট পোশাক পরে চলছে, রাস্তার বখাটে ছেলেরা সহজে উত্যক্ত করবে হিজাব বিহীন মেয়েটিকে। পত্রিকার পাতায় এ ধরনের নারী উত্যক্ত হবার অহরহ ঘটনা পড়তে পড়তে আমরা বিরক্ত। ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রকৃত আধুনিকতার বিরুদ্ধে নয়; বরং ইসলামই সর্বাধুনিক।
ইসলাম কারো উপর প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছুই চাপিয়ে দেয় না। বলা চলে, ব্যক্তির যা প্রয়োজন, ইসলামের তা-ই আয়োজন। অতএব, হিজাব নারীজাতির সম্মান যেমন বাড়ায়, ধর্ষণ ইভটিজিং থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। হিজাব মুসলিম নারীজাতির অধিকার। কোনো অজুহাতে এ অধিকার হরণ করা অমার্জনীয় অপরাধ। হিজাব নারীর ধর্মীয় স্বাধীনতা। বহুকাল ধরে বিশ্বব্যাপী ‘হিজাব বিতর্ক’ চলে আসছে। সময়ে সময়ে এ বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সম্প্রতি এ বিতর্ক আলোচনার তুঙ্গে! ভারতে হিজাব পরে প্রতিবাদ করা কর্ণাটকের কলেজ ছাত্রী মুসকান খান ভারতসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোটা দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছেন। সম্প্রতি তিনি বরাবরের মতো হিজাব পরে কলেজ ক্যাম্পাসে গেলে এক দল হিন্দু যুবকের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় তারা ‘জয় শ্রী রাম’ বলে তার সামনে শ্লোগান দিতে থাকে, যাদের পরনে ছিল বিজেপি ও আরএসএস সমর্থিত গেরুয়া ওড়না। এক পর্যায়ে তাদের জবাবে সাহসিকতার পরিচয় দেন মুসকান খান। তিনি ওই যুবকদের ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগানের জবাবে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির দিতে থাকেন। মুসকান খানের ওই বীরত্ব সূচক শ্লোগান ইতোমধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বহুল প্রচারিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। রীতিমতো ঈর্ষনীয় প্রশংসায় ভাসছেন এই মুসলিম তরুণী। মুসলিম অগ্নিকন্যা মুসকান খানের কণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি হিজাব বিতর্কের অবসান ঘটাক, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: খতিব, গাউসিয়া উসমান চৌধুরী জামে মসজিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন