আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কুমিল্লা-৫ সংসদীয় আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০—১৪ এপ্রিল ২০২১) সাহেবের ৭২তম জন্মদিন। উচ্চ আদালতের এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামে ১৯৫০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মোঃ আবদুল মালেক এবং মাতা মরহুমা জাহানারা বেগম। তারা চার ভাই তিন বোন৷ তার এক ছেলে এক মেয়ে।
এলএলবি এবং বিকম ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা জজকোর্টে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনৈতিক কারণে তিনি তার মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারেননি বলে জানা যায়। তিনি ১৯৮২ সালের ১৩ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট তিনি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তার আগে তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কুমিল্লা জেলার অবিভক্ত বুড়িচং থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন।
তিনি ১৯৯১ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মোট ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ৭ম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। এই জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০১৯ সালেও তাকে একই পদে বহাল রাখা হয়। শুধু রাজনীতে নয়, আইন অঙ্গনেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তিনি কয়েকবার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০২১-২০২২ সেশনে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে তার উদ্যোগে সংবিধানের প্রথম পকেট সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও রাজনীতি, আইন প্রণয়ন, আইন সংস্কারে তার অসামান্য অবদান রয়েছে এবং তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর অনেক দেশ সফর করেন।
২০২১ সালের ১০ ও ১১ মার্চ নির্বাচনের পর ১৫ মার্চ করোনা টেস্ট করাতে দেন তিনি। ১৬ মার্চ সকালে রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি হলে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে অবনতি হওয়ায় তাকে ফের আইসিইউতে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। বুধবার ১৪ এপ্রিল বিকাল পৌনে পাঁচটায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার আসনটি শুন্য হলে সেখানে এমপি নির্বাচিত হন বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, কুমিল্লা বারের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম খান।
শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায় ২৩ জুন ১৯৯৬ হতে ১৪ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরে ১৫ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল থেকে ১৫ জুলাই ২০০১ সাল পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মতিন খসরু। আইনমন্ত্রী থাকাকালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খোলে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন সহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের থানা ও জেলার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মননয়নে কুমিল্লা-৫ আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। বিজয়ী হন তারই রাজনৈতিক গুরুখ্যাত কুমিল্লা-৫ আসন থেকে চারবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অধ্যাপক মো. ইউনূস (মৃত্যু ২৭ মার্চ ২০২১)।
কিছু স্মৃতি : তিনি ছিলেন অত্যন্ত বড় মনের মানুষ। যেখানে উপদলীয় কোন্দলের কারণে একই দলের দুটি গ্রুপকে একসাথে বসানো দুঃসাধ্য, সেখানে তিনি আমাদের নির্বাচনী এলাকায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে এক মঞ্চে বসতেন। আর এই কাজটি সম্ভব হয়েছে বুড়িচং উপজেলার মেডিকেল, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনন্য অরাজনৈতিক সংগঠন উষা’র দৃঢ় সিদ্ধান্তের কারণে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অধ্যাপক মো. ইউনূসের উদার মনোবৃত্তির কারণে। কেননা, ২০০১ সালে তিনি তখন সংসদ সদস্য ছিলেন। মূলতঃ তারা দুজনেই অত্যন্ত বড় মনের উদারচেতা মানুষ ছিলেন।
উষার একটি অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্যে ‘রাজনীতিবিদদের বাঁশ দেয়া ভিটামিনসমৃদ্ধ’ শিরোনামে রম্য বিতর্কের অবতারণা করে আমি খসরু ভাইকে মঞ্চে বসিয়েই ‘তিন ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধের’ জন্য করা রীটের বিপক্ষে কেন গিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তার ব্যাপক সমালোচনা করলেও তিনি তা অত্যন্ত উদারভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্য। পরক্ষণে অন্য দলগুলোর নেতাদের সমালোচনার পর তিনি কিছুটা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন এবং আমার কাছ থেকে বিএনপির গঠনতন্ত্রটি চেয়ে নেন ও আমাকে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।অন্য নেতাদের ক্ষেত্রে বক্তব্য থামিয়ে দেয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তা না করে নজির স্থাপন করলেন।এমন নরমদিল মানুষ আমরা কোথায় পাব আর?
বাসায় গেলে আদর আপ্যায়নের কমতি ছিল না। সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচনের ক’দিন আগে চেম্বারে গেলে ব্যস্ততার পাহাড় মাথায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বটে। ভুলে যাননি আমাদেরকে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করার অর্ডার দিতে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে রাজধানীর পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তনে আমার লেখা ‘জীবন গঠনে শিক্ষা’ গ্রন্থের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি যে অনুপ্রেরণাদায়ক ও হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রেখেছিলেন, তা এখনও কানে বাজছে। তার কিছুদিন পর বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া পেশাজীবী কল্যাণ সমিতির বনভোজনে গিয়ে তিনি বললেন, ‘তুমি একটা অসাধারণ বই লিখেছো। ওয়ান্ডারফুল।’ আমি সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।বলতৈ দ্বিধা নেই, এই হলেন আবদুল মতিন খসরু! মানুষকে মূল্যায়ণ করতেন। আপামর জনসাধারণের নেতা ছিলেন তিনি।
তার সাথে বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ার বিভিন্ন স্থানে অঅয়োজিত অনুষ্ঠানে যাওয়া বা ঢাকায় বিভিন্ন অকেশনে দু’দশকে প্রায় শ’খানেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। একজন প্রকৃত নেতার যে বৈশিষ্ট্য, তা দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। একান্ত কথাগুলো না হয় বাদই দিলাম। নানান বিষয়ে তিনি মঞ্চে বসেও পরামর্শ করতেন। জানতে চাইতেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে। তিনি বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ গুণী ব্যক্তিদের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেছিলেন বুড়িচং উপজেলা সমিতি, ঢাকার নেতৃবৃন্দকে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সেটি এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার এই প্রত্যাশা পূরণে সভাপতি এমএ মতিন এমবিএ এবং সাধারণ সম্পাদক এসপি মিজানুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
তিনি মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী, আবু ছালেক মো. সেলিম রেজা সৌরভ ও সাজ্জাদ হোসেন স্বপন ভাইদের মত ব্যক্তিদেরকে কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় অসামান্য সহযোগিতা করার কারণে আজকে কুমিল্লা জেলার সেরা ১০টি কলেজের প্রায় অর্ধেকই বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত। এমনকি করোনার মধ্যে ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত মোশাররফ হোসেন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ১০৩ জন শিক্ষার্থীর সকলেই স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি লাভ করে চমকে দিয়েছেন দেশবাসীকে। আজকে তার জন্মদিনে, আমরা তার মত একজন বড় মানুষের অভাব খুবই অনুভব করছি।মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কায়োমনোবাক্যে ফরিয়াদ করছি, আমাদের প্রিয় মানুষ খসরু ভাইকে তিনি যেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন