শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এমপি বদির জেল-জরিমানা

প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে কক্সবাজার-৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আবদুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদ- দিয়েছেন আদালত। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত এ মামলায় আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। গত বুধবার ঢাকায় বিশেষ আদালত ৩-এর বিচারক আবু আহমদ জমাদার এ রায় দেন। রায়ে এমপি বদিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদ- দেয়া হয়। জামিনে থাকা এমপি বদি রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেন এবং তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তাকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দুদকের উপ-পরিচালক মো: আবদুস সোবহান ২০১৪ সালে ঢাকার রমনা থানায় এমপি বদির বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। সে সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিন সপ্তাহ কারাগারে থাকার পর হাইকোর্টের জামিনে তিনি মুক্তি পান। ২০১৫ সালের ৭ মে দুদকের উপ-পরিচালক মঞ্জিল মোর্শেদ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। এমপি বদি আয়কর বিবরণীতে, নির্বাচন কমিশনে ও দুদকের কাছে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন তার উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে তিনি দুদকে দেয়া সম্পদ বিবরণীতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯ হাজার ২৮৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তাই তাকে দুদক আইনের ২৬ (২) ধারায় তিন বছরে সশ্রম কারাদ- ও এই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হলো। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরও তিন মাস সাজা খাটতে হবে। রায়ে আরও বলা হয়, গোপন করা সম্পদ অবৈধ ও অসাধু পন্থায় আবদুর রহমান তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ উৎস হতে অর্জন করেছেন, তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে দুদক। তাই তাকে দুদক আইনের ২৭(১) ধারার অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হলো।
আবদুর রহমান বদি বহুল আলোচিত একজন ব্যক্তি। বিভিন্ন সময় তিনি আলোচনায় এসেছেন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। তার আগে থেকে তিনি আলোচনায় ছিলেন। এমপি হওয়ার পর আলোচনার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। কখনো ‘ইয়াবা সম্রাট’ কখনো ‘মানব পাচার’র ‘গডফাদার’, কখনো ‘জনপীড়ক’ বিশেষ করে সরকারী কর্মচারীর মারপিটকারী হিসাবে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন। ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার ও চোরাচালান সংক্রান্ত সরকারী পর্যায়ে যে তদন্ত হয়েছে, তার তালিকায় এমপি বদি ও পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের নাম শীর্ষ স্থান পেয়েছে। তার হাতে শারীরিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন এমন মানুষের তালিকাও দীর্ঘ, যার মধ্যে সরকারী কর্মকর্তা ও শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে চোরাচালানসহ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার দিকটি এ থেকেই অনুধাবন করা যায়। একজন আইন প্রণেতা হওয়ার পরও আইনের প্রতি তার শ্রদ্ধা কতটা, এ থেকে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কথায় বলে, আইনের হাত লম্বা। এটা তার বিরুদ্ধে দেয়া আলোচ্য রায়ে আবারও প্রমাণিত হলো। এ রায়কে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসাবে নেয়া যেতে পারে। এর মধ্যে এমন একটি বার্তা আছে, যাতে এমপি বদির মতো ব্যক্তিরা সতর্ক ও সাবধান হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এখনও শেষ কথা বলার সময় আসেনি। এমপি বদি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আপিলে কি হবে, আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমেই তা জানা সম্ভব হবে। পরের কথা পরে। এখনকার প্রেক্ষিতে একথা সহজেই বলা যায়, একটি নজির স্থাপিত হয়েছে। কেউ যে আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা যার যাই থাকুক না কেন, তাকে যে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা যায়, এ নজির থেকে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা বাড়বে।
দেশে আইনের শাসনের অভাব বা ঘাটতি রয়েছে। একথা অনেকেই বলেছেন এখানে বিচারহীনতার একটা ‘সংস্কৃতি’ গড়ে উঠেছে। সে কারণে সন্ত্রাস, খুন-খারাবী, নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, গুম, অপহরণ, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির মত গুরুতর অপরাধ দিনকে দিন বাড়ছে। মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আইন-শৃংখলা বাহিনী আইন-শৃংখলা সুরক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে তেমন কিছুই করতে পারছে না। অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল-মহলের একাংশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। এই সুবাদে এই শ্রেণীর অপরাধীরা এক ধরনের দায়মুক্তিও উপভোগ করে। বেপরোয়া অপরাধ বৃদ্ধির এটা বড় কারণ। দ্বিতীয়ত, আইন-শৃংখলা বাহিনীতে এমন ঢালাও দলীয়করণ হয়েছে যে, সেখানে দলবাজিটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, কীভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত হতে পারে? এটাও কারো অজানা নেই, বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত এবং হত্যা, সন্ত্রাস, ও নির্যাতনের শিকার অনেক মানুষই আইনের আশ্রয় নিতে বা বিচার প্রার্থী হতে সাহস পায় না; হলে আরো বিপদ ও ক্ষতির আশংকা থাকে বলে। আইনের শাসন ও বিচারের প্রশ্নে আস্থা শান্তি-শৃংখলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য হলেও এ ব্যাপারে হতাশাই কেবল বাড়ছে। এ পরিস্থিতি চলতে পারে না। সরকারী মহল থেকে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, অপরাধী যেই হোক, তাকে শাস্তি পেতে হবে। কেউ রেহাই পাবে না, তার অবস্থান ও পরিচয় যাই হোক না কেন। এই বক্তব্যকে ‘কথার কথা’ পর্যায়ে না রেখে কার্যকর করতে হবে। যে কোনো মূল্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। স্বীকার করতেই হবে, এমপি বদির সাজার মধ্যে একটি শুভ বার্তা বিদ্যমান রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন