দুই বছরের বেশী সময় ধরে আইএসের দখলে থাকা ইরাকি শহর মসুল পুনরুদ্ধারে মার্কিন ও ইরাকি সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে বলে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো জানিয়েছে। একই সময়ে ইন্টারনেটে প্রকাশিত আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদির একটি অডিও বার্তায় আইএস জঙ্গিদের শেষ পর্যন্ত ‘জিহাদ’ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কথিত অডিও বার্তায় এই আইএস নেতা বিজয়ের পূর্বলক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন বলেও আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। বাগদাদি মসুলের দখল বজায় রাখার পাশাপাশি সউদি আরব ও তুরস্কে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও কথিত অডিও বার্তায় জানা গেছে। পুনর্গঠিত ইরাকি সেনাবাহিনী এবং মার্কিন বাহিনী যৌথভাবে গত এক দশকের বেশী সময়ের মধ্যে মসুলে যখন সবচেয়ে বড় অভিযান পরিচালনা করছে, ঠিক তখনি আবু বকর আল বাগদাদির নতুন রণহুঙ্কার শোনা গেল। এতে আইএস মসুলের অধিকার বজায় রাখতে এবং যৌথ বাহিনী তা’ পুনর্দখলে যে সামরিক ছক তৈরী করেছে, তাতে নতুন করে হাজার হাজার মানুষের হতাহত ও উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একদিকে আইএস সুন্নি অধ্যুষিত মসুলের নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে গণমাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে পুনর্দখলের জন্য মরিয়া যৌথ বাহিনীও আকাশ থেকে বিমান হামলা চালিয়ে মসুলের সুন্নী মুসলমানদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিচ্ছে। অর্থাৎ দখল-পুনর্দখলের এই লড়াইয়ে বিজয় যে পক্ষেরই হোক, মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে মসুলের সাধারণ বাসিন্দাদের।
এ বিষয় অনেকটাই স্পষ্ট বিদ্রোহী, দায়েশ বা আল নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ায় তাদের অবস্থান হারিয়েছে। রাশিয়া এবং ইরান সমর্থিত বাশারের বাহিনী সিরীয় বিদ্রোহী অধ্যুষিত বেশীরভাগ অঞ্চল পুনর্দখল করে নিয়েছে। বিশেষত, সিরীয় বাহিনী আইএস অধ্যুষিত আলেপ্পো পুনর্দখলের পর ইরাকি শহর মসুলই হচ্ছে তাদের শেষ বড় ঘাঁটি। অতএব, মসুলের অধিকার রক্ষায় আইএস হয়তো সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের ঝুঁকি নেবে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ইরাকি ও মার্কিন বাহিনী প্রবেশের আগে সাদা পতাকাবাহী গাড়ীতে করে শত শত নারী ও শিশু মসুল ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মসুল খুব শীঘ্রই আইএসের সাথে যৌথ বাহিনীর একটি রক্তক্ষয়ী রণক্ষেত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ কথা নিশ্চিত যে, এখনো হাজার হাজার পরিবার মসুলে নিজেদের বাস্তুভিটা আঁকড়ে পড়ে আছে। গত ১৭ অক্টোবর থেকে মসুল পুনরুদ্ধারের অভিযান শুরুর পর থেকেই সেখানে পানির সংকট, খাদ্য ওষুধ-পথ্যের সংকটে এক মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। এখন চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে সে সব নিরাপত্তাহীন ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার বিষয়টিই অধিক গুরুত্বের দাবী রাখে।
এই মুহূর্তে মসুলের লাখ লাখ মানুষকে ভাগ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষায় যৌথ বাহিনী এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রধান লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাজারো নিরস্ত্র মানুষের প্রাণের বিনিময়ে কোন জনপদ অধিকার বা দখল করা কোন সভ্য দেশের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য হতে পারে না। আমরা শুরু থেকেই দেখে আসছি, পুনর্গঠিত ইরাকী শিয়া সেনাবাহিনী ও মার্কিন বাহিনী এক জোট হয়ে সুন্নী অধ্যুষিত শহর ও জনপদে হত্যা-সন্ত্রাসের তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। মসুল অধিকারের পর এই যৌথ বাহিনী সেখানকার সুন্নী মুসলমানদের প্রতি কি আচরণ করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এটা সবারই জানা, ইরাক-মার্কিন জোট এবং তাদের সেনারা যুগপৎভাবে সুন্নীদের হত্যা ও উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের এই নীতি ও কর্মকা- মানবতাবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ভাগ্য বিড়ম্বিত সুন্নীদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সকল প্রকার মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে মানবতাবাদী বিশ্বকে সোচ্চার হতে হবে। এ ব্যাপারে সকলেই একমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হস্তক্ষেপ ও দখল যতদিন মধ্যপ্রাচ্যে বহাল থাকবে, যতদিন হত্যা-নির্যাতন ও মানবিক বিপর্যয় থামবে না। অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই এটা প্রতিভাত যে, এই যুদ্ধ-সংঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নী মুসলমানরা। পশ্চিমারা মুসলমানদের জাতিগত ও ধর্মীয় মতাদর্শিক বিরোধকে কাজে লাগিয়ে এখানে তাদের হেজিমনি দীর্ঘায়িত করতে চায়। মসুলে ইরাকী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর সেখানে যেন জাতিগত বৈষম্য, বিভক্তি ও সংঘাত বেড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে মসুলের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষাই হোক সকল পক্ষের মূল লক্ষ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন