বৈশ্বিক করোনা মহামারির প্রভাবে তীব্র কর্মী সঙ্কটে পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে গত বছর থেকেই। দীর্ঘদিন যাবত ১৩ রিক্রুটিং এজেন্সির মনোপলি ব্যবসার দরুন সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় দেদারসে বাড়ছে। চড়া অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নির্বিকার। দেশটিতে কর্মরত দেড় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিসম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, বিদেশগামী কর্মীদের ভিটেমাটি বিক্রি নয়, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে বিদেশে যেতে হবে। বিদেশগামী কর্মীদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
অভিবাসী শ্রমিকনির্ভর আবাসন ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আইনগুলো সাময়িকভাবে শিথিল করেছে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো যার সুফল পাচ্ছে সিঙ্গাপুরে বর্তমানে কর্মরত ও যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি কর্মীরাও। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় (সর্বমোট) ২ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। বায়রার এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে জানান, ১৩ রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট করে সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় বাবদ জনপ্রতি ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে নাভিশ্বাস উঠছে। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নির্বিকার। বায়রার ওই সাবেক নেতা সরকার ঘোষিত সিঙ্গাপুরের নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বিদেশগামী কর্মীদের হয়রানি বন্ধ এবং বৈধ সকল রিক্রুটিং এজেন্সিকে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।
এন্ট্রি অ্যাপ্রুভাল, পিসিআর টেস্ট এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বাংলাদেশি, ভারতীয়, নেপালসহ অন্যান্য দেশের কর্মীরা সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে। দেশটির জাহাজ, নির্মাণ খাতসহ অন্যান্য খাতে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসী মো. আমিনুল ইসলাম তুহিন এ তথ্য জানিয়েছেন। তার মতে, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাসেবা খুবই উন্নত। যদিও বর্তমানে প্রতিদিনই দশ থেকে পনের হাজার নারী-পুরুষ করোনায় শনাক্ত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তুহিন বলেন, দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সীমান্ত বন্ধ থাকায় সিঙ্গাপুরের নির্মাণ ও মেরিন সেক্টরের কোম্পানিগুলো চরম কর্মী সঙ্কটে পড়েছিল। কর্মী সঙ্কটের মধ্যেই দেশটিতে নির্মাণ খাতে কাজ করছেন এমন অনেক অভিজ্ঞ কর্মীর কাজের অনুমতিপত্রের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, কাজের অনুমতিপত্রের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া কর্মীরা নতুন চাকরি খুঁজে নিতে আরো অতিরিক্ত ৩০ দিন সময় পাবেন। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই ওই কর্মীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হতো। সিঙ্গাপুরের মেরিন শিপইয়ার্ড এবং প্রক্রিয়াজাত সেক্টরে কর্মরত বিদেশি শ্রমিক, যাদের কাজের অনুমতিপত্রের মেয়াদ জুলাই থেকে শুরু করে গত ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়েছে তাদের অনুমতিপত্রের মেয়াদ দুই বছরের জন্য বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি মেয়াদ বাড়ানোর সময় কর্মীর বয়স ও পূর্ববর্তী কাজের যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া হতো, তার আর প্রয়োজন হবে না।
২০২১ সালের শেষের দিকে সিঙ্গাপুরের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, নির্মাণ ও প্রক্রিয়াজাত সেক্টরের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে নতুন বিদেশি কর্মী নিয়োগে ন্যূনতম দক্ষতার বাধ্যবাধকতা ছিল সেটি আর থাকছে না। ফলে এখন থেকে অদক্ষ কর্মীদেরও নিয়োগ দিতে পারবে এসব খাতের কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও চীন থেকেই এসব খাতের কর্মীদের নিয়োগ দিতে হবে। অন্যদিকে যেসব কর্মীর সিঙ্গাপুরে কাজের পূর্বঅভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের নিয়োগ ও কাজের অনুমতিপত্র বরাদ্দের বিষয়ে কোম্পানিগুলোর জন্য আর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার সীমা থাকছে না। গত ১ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোকে এ ওয়েভার দিয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার। সিঙ্গাপুর থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জনশক্তি রফতানিকারকরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিকনির্ভর আবাসন ও শিল্প খাতে শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এতদিন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই পূরণ করে এসেছে। ফলে মহামারির পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখাটাই সিঙ্গাপুরের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে সিঙ্গাপুরে আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই দেশটি শ্রমিক সঙ্কটের কবলে পড়ে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০ হাজার কর্মী রফতানি হতো সিঙ্গাপুরে। করোনার আগে ২০১৯ সালে দেশটিতে ৪৯ হাজার ৮২৯ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে ২০২০ সাল থেকে কর্মী পাঠানো কমতে শুরু করে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে কর্মী গিয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার ৮৫ জন। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ১৩ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শুধু সিঙ্গাপুরেই ২৭ হাজার ৮৭৫ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এছাড়া দেশটিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩ হাজার ৮৪১ জন চাকরি লাভ করেছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৯৫ জন কর্মী দেশটিতে চাকরি লাভ করছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই বিভিন্ন দেশে চাকরি লাভ করেছে ১ লাখ ৯ হাজার ১৪৮ জন কর্মী।
বিএমইটির সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে ৪১ হাজার ৩৯৩ জন, ২০১৭ সালে ৪০ হাজার ৪০১, ২০১৬ সালে ৫৪ হাজার ৭৩০ ও ২০১৫ সালে ৫৫ হাজার ৫২৩ জন বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে পাড়ি জমান। ১৯৭৯ সালে ১১০ জন কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশটিতে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৮ বাংলাদেশি কর্মী চাকরি লাভ করেছে। দেশটিতে প্রবাসী কর্মীদের বেতন বেশি হওয়ায় প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে। সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলে রেমিট্যান্স আয় আরো অনেকাংশে বাড়ত বলে অভিজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করেছেন।
জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সিঙ্গাপুরের মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশই গড়ে উঠেছে অভিবাসী শ্রমিকদের দিয়ে। বিশেষ করে দেশটির নির্মাণ ও জাহাজ শিল্পের মতো ভারী খাতগুলো বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কম খরচে পাওয়া শ্রমিকদের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত ২ লাখ ৬২ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয়ের পরিবর্তে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মনোপলি ব্যবসার সুবাদে সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে, এসব বিষয়ে দেখার কেউ নেই। তিনি শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও দেশের স্বার্থে সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের মাধ্যমে দেশেটিতে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানান।
এদিকে, গত বছর দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, করোনার কারণে সিঙ্গাপুরের নির্মাণ ও জাহাজ শিল্পে মারাত্মক শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। এ সঙ্কটকে আরো প্রকট করে তুলেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের আগমনের ওপর জারিকৃত বিধিনিষেধ। বিগত ২০২০ সালে দেশটির নির্মাণ খাতের সঙ্কোচন হয়েছে ৩৬ শতাংশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বছর প্রথম দিকে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার শ্রমিক নেবে সিঙ্গাপুর। আর ইউরোপের দেশ রোমানিয়া নিতে পারে অতিরিক্ত দুই হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। মন্ত্রী বলেন, কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশিরা ফেরত এসেছে, কিন্তু এর মধ্যে সিঙ্গাপুর আমাদের জানিয়েছে, তারা এখান থেকে ১০ হাজার শ্রমিক নেবে। তবে কোন কোন খাতে ওই শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হবে সে সম্পর্কে আরো আলাপ-আলোচনা হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন খাতেই তারা লোক নেবে। ঐ সময়ে সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার বিষয়ে মন্ত্রী মোমেন আরো বলেন, সিঙ্গাপুরে আমাদের মিশন গড়ে পাঁচ শতাধিক ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করছেন। এটা সুখবর, আমরা এটা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন। সিঙ্গাপুরের কর্ম-পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, সিঙ্গাপুরে যারা কাজ করে, মোটামুটি তাদের অভিযোগ-আপত্তি খুব একটা থাকে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন