বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাষ্কিৃত ও অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে কিছু পরিমাণ সম্পদ আহরণ করা হলেও সেটা বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত সম্পদের তুলনায় ধুলিকণাতুল্যও নয়। সম্পদ আহরণ তো পরের কথা সম্পদ জরিপ করার উপযোগী জাহাজ পর্যন্ত আমাদের নেই। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার প্রায় সমপরিমাণ সম্পদ সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সমুদ্রের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা টেকসই উন্নয়নের জন্য জরুরি ও অপরিহার্য। সময়ে সময়ে বাপেক্সসহ বিদেশি সহায়তায় যৎসামান্য জরিপ চালানো হলেও বঙ্গোপসাগরে অমিত ও অপার সম্ভাবনা সর্ম্পকে আমরা খুব কমই জানি।
সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিকে বলা হয়, ‘ব্লু ইকোনমি’ বা নীল অর্থনীতি। নীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে: বাংলাদেশের যে সমুদ্রসীমা আছে তা মূল ভুখন্ডের ৮১ ভাগের সমান। পুরো বিশ্বে আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে দেড় লাখ জাহাজ চলাচল করে, সেখানে বাংলাদেশের জাহাজ মাত্র ৭০টি। অথচ, এই পথে পণ্য পরিবহনের অর্থনীতির আকার ৯০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া কনটেইনারে নির্মাণে ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে। এশিয়া অঞ্চলে ৭৪ শতাংশ কন্টেইনার ব্যবহার করা হয়। প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কন্টেইনারের চাহিদা আরো বাড়বে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বন্দর থাকলেও তা দেশের জন্য যথেষ্ঠ নয়। এমতবস্থায় মাতারবাড়ী ও সাতক্ষীরা জেলার চাঁদনিমুখা সুন্দরবন সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদ সন্নিহিত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হলে তা নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সহায়তা করবে। এখাত থেকে আগামী কয়েক বছরেই ১০০ বিলিয়ন রপ্তানি করা সম্ভব। এ জন্য সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পদ সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে মোট সমুদ্রসীমার বিস্তৃতি ৬৬৪ কিলোমিটার। কিন্তু মাছ আহরণ করা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর তাই মাছের বৈশ্বিক হিস্যা মাত্র দুই দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ, চীন একাই বিশ্বের ৬১ শতাংশ মাছের যোগান দিচ্ছে।
একইভাবে সাগরের সীমানায় মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সমুদ্রবক্ষের বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস। শুধু মাছ কিংবা খনিজ সম্পদ নয়, নিজেদের সীমানায় সাগরকে ব্যবহার করে পালটে দেয়া যেতে পারে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির চিত্র। এছাড়া নীল পানিরাশির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সামুদ্রিক সম্পদ। তেল, গ্যাস, মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, শামুক, ঝিনুক, মাছ, অক্টোপাস, হাঙর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ রয়েছে নীল সাগরে। সেখানে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ২০ জাতের কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ী ও ৩৬০ প্রজাতির অন্যন্য মাছ। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার ফলে নীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জনের ক্ষমতা লাভ করেছে। একটি হলো প্রাণীজ আর একটি হলো অপ্রাণীজ। প্রাণীজের মধ্যে রয়েছে মৎস সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা গুল্ম লতা ইত্যাদি। অপ্রাণীজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজও খনিজ জাতীয় সম্পদ। যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরো রয়েছে ১৭ ধরনের খনিজ বালু। যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্রানেট, কাযানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি।
স্থলভাগের আয়তন যেখানে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার সেখানে সমুদ্রে ১ লাখ ১৮ হাজার৮ ১৩ বর্গকিলোমিটারের মালিকও এখন বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্য মতে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে সাফল্য অর্জন করবে, বাংলাদেশ তার শীর্ষে রয়েছে। বর্তমানে গড়ে ৬ লাখ টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ নীল অর্থনীতি থেকে আসে। বর্তমানে আমাদের জেলেরা ৩৫ থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্য থেকে মাছ আহরণ করে। গভীর সমুদ্র পর্যন্ত গিয়ে মাছ আহরণ করতে পারলে বাংলাদেশের মৎস্য রপ্তানিতে সৃষ্টি হবে নতুন মাইল ফলক তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। বঙ্গোপসাগরকে বলা হয় সম্পদের ভাণ্ডার। তেল গ্যাসসহ নানা মূল্যবান পদার্থের খোঁজ মিলেছে বঙ্গোপসাগরে।
সমুদ্র অর্থনীতিকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বে সরকারি প্রতিষ্ঠান সেফ আওয়ার সি’র তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া মাছ থেকে খাবার, মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, সস টিটেসিনান তৈরি করা সম্ভব, যা নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তা বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। শুধু সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে। সেভ আওয়ার সি’র গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ম্যাগনেশিয়ামের লবণ এয়ারক্রাফট নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পটাশিয়াম লবণ সার ও নানা ধরনের রসায়ন শিল্পে ব্যবহার করা হয়। ওষুধ তৈরিতে ব্রোমিন এবং ওয়াল বোর্ড নির্মাণে জিপসাম ব্যবহৃত হয়। সোডিয়াম ক্লোরাইড খাবার লবণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সমুদ্র থেকে জীবন রক্ষাকারী নানা ধরনের ওষুধ পেতে পারি। প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, আগামী প্রজম্মের ওষুধের যোগান আসবে সমুদ্র থেকে।
বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রপ্তানি পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৬০০ ব্যাণিজ্যিক জাহাজ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে আনা নেওয়া করা হয়। ২০০৮ সালে বেসরকারি মালিকানায় বাংলাদেশি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬টি। কিন্তু সমুদ্র পরিবহনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন তা ৭০-এ দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নৌপরিবহন খাতে ২০০৮ সালে রেজিস্ট্রি করা জাহাজ ছিল চার হাজার। এখন তা ৯ হাজারে পৌঁছেছে। সেভ আওয়ার সি’র তথ্য অনুযায়ী, পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বাংলাদেশি জাহাজ যুক্ত হওয়ায় দেশে গড়ে উঠেছে শিপিং এজেন্সি ফেইট-ফরোয়াডিং, ব্যাংক-বীমাখাত। এখাতে নতুন কর্মসংস্থান ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় আরো দেখা গেছে, বর্তমানে ২৫০ প্রজাতির মাছের বিপরীতে সাগরে রয়েছে অন্তত ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে, যার সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত।
বিশ্বব্যাংক ২০১৮ সালে ‘টুয়ার্ডস এ ব্লু ইকোনমি: এ পাথওয়ে ফর নানটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটা সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ও বড় আকাল রয়েছে বাংলাদেশে। সমুদ্র বিজয় নিয়ে মাতামাতি হলো, তারপর সে অর্থনীতি নিয়ে যে গতিতে এগোনো উচিত, বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। বলা বাহুল্য, নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর তেল-গ্যাস সম্পদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনায় এসেছে। কারণ, এ অঞ্চলের সমুদ্রে বড় সড় মজুদ রয়েছে। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর দেখা গেল, মিয়ানমানমার দ্রুততার সঙ্গে এর সুফল ঘরে তুলতে শুরু করল। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাথে বিরোধ নিস্পত্তির পর বছর দুয়েকের মাথায় শুধু গ্যাসের আবিষ্কার নয়, বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তোলা শুরু করে দিয়েছে মিয়ানমার। এই গ্যাস তারা নিজেরা ব্যবহার করছে এবং রপ্তানি করছে চীনে। তার অধিকাংশ ব্লকে অনুসন্ধানের কাজ চলছে। কারণ, দেশটি বিরোধ মেটার আগে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ভারতও বসে নেই। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশে দেশটির সরকারি বেসরকারি তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো জোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে ও বিপুল মজুদের আশা করছে। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের আগাম প্রস্তুতি ছিল না। বিরোধ নিষ্পত্তির পরও আমাদের টনক নড়েনি।
সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর ২৬টি নতুন ব্লকে বিন্যাস করে এর মধ্যে ১১টি অগভীর ও ১৫টি সমুদ্রের ব্লক হিসেবে চিিহ্নত করা হয়েছে। এরপর বহু সময় কেটে গেছে। সাম্প্রতি চারটি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু আমরা একটি কূপও আমরা নির্মাণ করতে পারেনি। বাকি ২২টি ব্লক স্থবির হয়ে রয়েছে। জ্বালানির সংকটে বিপদে আছে দেশের শিল্পখাত। অথচ, দেশের জ্বালানি ব্লকগুলো থেকে জ্বালানি অনুসন্ধানের উদ্যোগ বছরের পর বছর স্থবির হয়ে রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন