ছবিটি তুলেছিলেন বিবিসির রিপোর্টার রিকার্ডো সেনরা এবং এরপর ছবিটি টুইটারে ভাইরাল হয়, শেয়ার হয় এক লাখের বেশি। লন্ডনের সবচেয়ে পুরোনো এবং বড় একটি খাবার-দাবারের বাজার, বারা মার্কেটে একটি কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ পাউন্ডে (২১৮ ডলার)।
এই ছবিটি রিকার্ডো সেনরার নিজের দেশ ব্রাজিলে রীতিমত সাড়া ফেলে দিল। একটা কাঁঠালের যে এত দাম হতে পারে, তা দেখে টুইটারে রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করলেন অনেকে। রসিকতা করে কেউ কেউ বলছিলেন, এবার তারা লন্ডনে গিয়ে কাঁঠাল বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যাবেন। ব্রাজিলের বহু জায়গাতেই মাত্র এক ডলার দশ সেন্টে কাঁঠাল কিনতে পাওয়া যায়। কেবল ব্রাজিল নয়, বিশ্বের অনেক গ্রীস্মমণ্ডলীয় দেশেই কাঁঠাল বেশ সস্তায় কেনা যায়।
অনেক দেশে তো একেবারে বিনা মূল্যে গাছ থেকে পেড়ে কাঁঠাল খাওয়া যায়। বেশির ভাগ কাঁঠাল আসলে রাস্তাতেই পঁচে নষ্ট হয়, অন্তত ব্রাজিলে তো বটেই। তাহলে লন্ডনে একটি মাত্র কাঁঠালের এত বেশি দাম হাঁকানোর কারণ কী? এই ফল এখানকার ভোক্তাদের কাছে অভিনব বলে? আর আন্তর্জাতিক বাজারেই বা কেন সম্প্রতি কাঁঠালের দাম বেড়ে গেল?
প্রথমত, একটা মোদ্দা কথা মনে রাখা দরকার: কোন জিনিস কোথায় বিক্রি হচ্ছে, তার ওপরে আসলে নির্ভর করে এর দাম। এটা যে কোন জিনিসের বেলায় সত্য। "ব্রাজিলেও কিন্তু কাঁঠালের দামের হেরফের আছে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আপনি বিনামূল্যে এটি গাছ থেকে পেড়ে নিতে পারেন। কিন্তু অন্য অনেক জায়গায় কিন্তু আবার এই কাঁঠালের অনেক দাম," বলছেন এস্টানসিয়া ডাস ফ্রুটাস কোম্পানির প্রধান নির্বাহী সাব্রিনা সারটোরি। সাও পাওলোতে এই কোম্পানির একটি ফলের বাগানে তিন হাজারের বেশি জাতের ফল গাছ আছে।
তবে লন্ডনে একটি কাঁঠালের দাম কেন এত বেশি, তার আরও অনেক কারণ আছে। কাঁঠালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেশ জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা এর বেশ কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করছেন। যেমন, কাঁঠাল বেশ দ্রুত পঁচে যায়। এটি কেবল একটি মৌসুমে হয়। আর ফল হিসেবে কাঁঠালের আকৃতি বেশ বড়। "কাঁঠাল বেশ ভারী, খুব দ্রুত পেকে যায় এবং এর একটা বিকট গন্ধ আছে, যেটা সবাই পছন্দ করবে না", বলছেন সাব্রিনা সারটোরি।
একটি কাঁঠাল ৪০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এটি মূলত পাওয়া যায় এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে এই ফল খুবই পচনশীল এবং সুপার মার্কেটে এর 'শেলফ-লাইফ' একেবারেই সংক্ষিপ্ত। যেসব দেশে কাঁঠাল হয়, সেসব দেশেও যে এটি খুব আদৃত, তা নয়। কিন্তু সম্প্রতি উন্নত দেশগুলোতে কাঁঠালের বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর পেছনে আছে নিরামিষাশীরা, যারা এখন মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁঠাল বেশ পছন্দ করে।
কাঁঠাল যখন রান্না করা হয়, তখন এটি খেতে অনেকটা অনেকটা গরু বা শুকরের মাংসের মতো লাগে। ফলে টফু বা কর্নের মতো এটিও এখন মাংসের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্রিটেনে এখন নিরামিষাশী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ বলে ধারণা করা হয়। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কাঁঠাল যখন খুব বেশি পেকে যায়, এবং এটি ঘটে বেশ দ্রুত, তখন কিন্তু এটি খেতে বেশ মিষ্টি এবং কেবল মিষ্টি খাবার তৈরির কাজেই ব্যবহার করা যায়।
কাজেই ভোক্তাদের জন্য সস্তায় কাঁঠাল পাওয়ার আরেকটা উপায় হচ্ছে, টিনজাত কাঁঠাল কেনা। ব্রিটেনের সুপারমার্কেটে এক টিন কাঁঠালের দাম প্রায় চার ডলার। কিন্তু অনেকে বলেন, টিনজাত কাঁঠাল খেয়ে আসল কাঁঠালের স্বাদ পাওয়া যায় না। কাঁঠাল যেহেতু আকারে অনেক বড়, তাই এটি পরিবহন করাও বেশ কঠিন। আর কেবল একটি নির্দিষ্ট মৌসুমেই ফলটি পাওয়া যায়। অসম আকৃতি এবং ওজনের কারণে এটি প্যাকেটজাত করা কঠিন। অন্যান্য ফল যেমন একই সাইজের বক্সে ভরা যায়, কাঁঠালের বেলায় সেটি সম্ভব নয়। আর বাইরে থেকে দেখে আসলে বোঝা যায় না, কোন কাঁঠাল ভালো আছে, নাকি খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে গেছে।
আর কাঁঠাল সবচেয়ে বেশি হয় দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। এটি বাংলাদেশ এবং শ্রীলংকার জাতীয় ফল। এসব দেশ থেকেই মূলত কাঁঠাল রফতানি হয়, কিন্তু সেখানে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও খুব ভালো নয়। গাছ থেকে পাড়ার পর কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে সেটার ভালো ব্যবস্থা নেই। যার ফলে, ৭০ শতাংশ কাঁঠালই আসলে নষ্ট হয়। ভারতে আবার কাঠাল বেশ অপাংক্তেয় একটি ফল, গ্রামীণ এলাকায় এটিকে দেখা হয় গরীব লোকে খাদ্য হিসেবে।
বিশেষজ্ঞরা সচেতনতার অভাবকেও আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন- যদিও কাঁঠাল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বহু ভোক্তা এখনো জানেন না এটির স্বাদ কেমন এবং কত ধরনের খাবার তৈরিতে কাঁঠাল ব্যবহার করা যায়। নেদারল্যান্ডসে অভিনব সব বিদেশি ফল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টোরেজ ট্রপিক্যাল বিভি'র মালিক ফ্যাব্রিসিও টোরেজ বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বে বিমানে পণ্য পরিবহনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
"এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ থেকে ফল আসে যাত্রীবাহী বিমানে। বিমান সংস্থাগুলো এখন এমন পণ্য পরিবহনে উৎসাহী যাতে অনেক বেশি ভাড়া পাওয়া যাবে। কাঁঠাল তো খুব পঁচনশীল এবং এর বাজারও তত বড় নয়। কাজেই বেশি পরিমাণে আমদানিতে এখনো লাভ নেই। এ কারণেই কাঁঠালের খুচরা বিক্রয় মূল্য এত বেশি," বলছেন তিনি। তবে সব ধরনের বাধা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কাঁঠালের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রি এআরসি'র হিসেবে, ২০২৬ সাল নাগাদ কাঁঠালের আন্তর্জাতিক বাজার ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যাবে। প্রতি বছরে এই বাজার বাড়বে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ২০২০ সালে বিশ্বে কাঁঠালের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে, ৩৭ শতাংশ। এর পরে ছিল যথাক্রমে ইউরোপ (২৩%), উত্তর আমেরিকা (২০%), বাকি বিশ্ব (১২%) এবং দক্ষিণ আমেরিকা (৮%)। এ থেকে বোঝা যায়, দক্ষিণ আমেরিকা, বিশেষ করে ব্রাজিলে আসলে এখনো কাঁঠালের সেরকম কদর নেই। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন