(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কানাডার রাস্তাঘাটে মানুষজন নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের ৭০ গুণ বড় কানাডা। লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন কোটি। যখন আমি হাঁটতে বের হতাম, তখন মনে হতো কোনো নীরব জনপথ দিয়ে পথ চলছি।
কানাডায় কোনো শব্দদূষণ নেই। রাস্তায় কুকুর নেই। তাই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যায় না। কুকুর এদেশে গৃহপালিত বিশ্বস্ত পশু। কুকুর চলার সাথী। হতাশ জীবনে আলোর দিশারী। এ কারণে life with a dog is fine এটা এখানকার মানুষের জীবন দর্শন। নির্দিষ্টস্থান ছাড়া রাস্তায় ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে না। কোথাও আড্ডা বা জটলা নেই। ছেলে-মেয়েদের অসভ্যতা এবং গার্ল ফ্রেন্ড বা কল গার্ল নিয়ে পার্কে রাস্তাঘাটে অশ্লীলতা কোথায়ও দেখিনি। এ দেশে পরকীয়া প্রেম গুরুতর অপরাধ। নারী-পুরুষের ছবি সম্বলিত বাণিজ্যিক বিলবোর্ড নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রপ্রধানের মূর্তি বা ভাস্কর্য আমার দেখা ছয়টি শহরের কোথাও দেখিনি। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেদারসে অশ্লীলতা চলছে। কানাডার আইনে এসব নিষিদ্ধ। একটি জিনিস অবাক হওয়ার মতো, গাড়িতে তেল নেওয়ার সময় দেখলাম, পেট্রোল পাম্পে (ম্যাপের উপর Canada petro লেখা) কোনো লোকজন নেই। শুধু গাড়ির মালিকরাই যার যার তেল নিজেরাই নিচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড নির্দিষ্ট স্থানে দিয়ে কম্পিউটারে লিখতে হবে কী পরিমাণ তেল লাগবে। সবকিছু ওকে হলে গাড়ির চালক নিজেই পাইপ লাগিয়ে তেল নিয়ে চলে যায়। এই সিস্টেম বাংলাদেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। কানাডার অনটারিও লন্ডন শহরে খামারিদের একটি বিশাল মার্কেট আছে। নাম ফারমারস মার্কেট। কানাডার কৃষকদের উৎপাদিত অর্গানিক পণ্য শুধু এই মার্কেটে বিক্রি হয়। আমরা পুরো মার্কেট ঘুরে দেখলাম। মাছ-মাংসসহ সবধরনের খাদ্য পণ্য এখানে পাওয়া যায়।
এক কথায় বলতে হয়, কানাডায় সবকিছুই নিয়ম-শৃংখলার মধ্য দিয়ে চলছে। ফলে পানি, বায়ু, মাটি, শব্দ এবং পরিবেশ দূষণ থেকে দেশটি সম্পূর্ণ মুক্ত। এ দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই। আমি দেখিনি। দুই একজন মানুষ দেখেছি, রাস্তায় সাহেবী পোশাকে পিয়ানো বাজাচ্ছে, সাদা কাগজে লেখা I am homeless... এই দৃশ্য আমি নায়াগ্রা ফলসে দেখেছি। টরেন্টো শহরে রাতের বেলায় একজন মানুষকে পুরো শরীর আবৃত করে শুয়ে থাকতে দেখেছি। তার পাশে অচেনা কোনো মানুষ একটি প্যাকেটে খাবার এবং নতুন জুতো রেখে গেছে। এক মধ্য বয়সি মহিলা পরিধানে ভালো কাপড়-চোপড় পরে অনটারিও লন্ডন শহরের মার্শাল শপিং সেন্টার Black Friday তে একটি কাগজে লেখা ব্যানার টানিয়ে রেখেছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। ব্যানারে লেখা আছে Help me, God give you. এ ধরনের কিছু মানুষ চলার পথে দেখেছি। কানাডায়ও গরিব মানুষ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অলিগলিতে, বাসাবাড়িতে, মসজিদে, হাটবাজারে যেভাবে পেশাজীবী ভিক্ষুক দেখা যায় সেটা এদেশে একেবারেই নেই। হাত পেতে ভিক্ষা চায় এরকম মানুষ রাস্তাঘাটে দেখিনি। এ দেশের গরিব মানুষও হাত পেতে কিছু চাওয়া নিজেকে অপমানবোধ করে। শহরের ওয়ালমার্ট সুপার মার্কেট, কস্টকো, ডলারমা, মেট্রো, হ্যাডসন এন্ড বে এর মতো বড় বড় শপিংমলে ৮৫/৯০ বছর বয়সের মানুষকে কাজ করতে দেখেছি। সরকার যে বয়স্কভাতা দেয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই বেশি বয়সেও কাজ করতে হয়। এখানে কে বড় কে ছোট চাকরি করে এ নিয়ে কোনো হিংসা, অহংকার, গীবত নেই। সবাই একটি পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ করে। পাছে লোকে কিছু বলে এই চিন্তা তাদের মধ্যে নেই। নিজ নিজ কাজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। অফিসে দুপুরে লাঞ্চের সময় সবাই এক জায়গায় বসে খেতে দেখেছি। এদেশেও গরিবদের সাহায্য করা হয়। কিন্তু নীরবে অর্থাৎ বিষয়টি অজানা থেকে যায়। যে সাহায্য করলো সে কাউকে বলে বেড়ায় না। আর যে সাহায্য পেলো সেও জানে না কে তাকে সাহায্য করলো। ইসলামের এই শিক্ষাটা এদেশে দেখে ভাবলাম, আমরা বাংলাদেশের মানুষ কাউকে কিছু দান করলে অনেকটা বাণিজ্যিক কায়দায় তা প্রচার করে থাকি। এক কথায়, আমি বড় লোক, মানুষকে এটা জানাতে হবে। এসব কর্দয কাহিনী আবার ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ কাজে কে কত টাকা দিল সেটাও জুমার নামাজে প্রচার করা হয়। এ এক অমানবিক প্রতিযোগিতা চলছে বাংলাদেশে।
চলার পথে ডান-বাম মেনে চলতে হয়। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখিনি। অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, স্কুলবাস, ফায়ার ব্রিগেড গাড়ি আসলে ডানে বামে চলমান গাড়িগুলো ধীরগতিতে থেমে যায়। যদি কোনো বয়স্ক মানুষ রাস্তা পার হতে দেখে তখনও একই গতিতে গাড়ি থেমে যায়। মনে হয়, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি দেশটিকে এতো নিয়ম-শৃংখলার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করছে। একই দৃশ্য আমি ২০০৫ সালে হজের সময় মদিনায় দেখেছিলাম। সেই দৃশ্য ২০২১ সালে কানাডায় এসে দেখলাম। প্রতিটি সুপার মার্কেট, পার্ক এবং মানুষের সমাগম হয় এমন সব স্থানে ওয়াশ রুম, টয়লেট প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উপাদানে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব পরিচর্যার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের। মনে হয়, যেন বাথ রুমগুলো এইমাত্র নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এধরনের সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং মানবিক দৃশ্য একেবারেই উঠে গেছে। যার যা আছে তাই নিয়েই কানাডার মানুষ সন্তুষ্ট। তাদের ভাবভঙ্গিতেই তা প্রকাশ পায়। আহামরি কোনো চিন্তা নেই। অর্থের প্রতিযোগিতা নেই। একদিনে কোটিপতি হওয়ারও স্বপ্ন নেই। মাইন্ডফুলনেস লাইফ তারা পছন্দ করে। আজকের দিনটি ভালো যাক, এটাই তাদের জীবন দর্শন। এসব কারণে তাদের গড় আয়ূ বেশি। বাংলাদেশের মানুষ যার যত আছে সে আরও পেতে চায়। একটি গাড়িতে বাংলাদেশের মানুষ সন্তুষ্ট নয়। ধনীদের অর্থের লোভ বাংলাদেশে এতো বেশি, যা ভাবা যায় না। অবৈধ আয়ের হাত যে কত প্রসারিত, নিত্যদিনের মিডিয়া দেখলেই তা বুঝা যায়। অতিরিক্ত অর্থ যে অনর্থের মূল, এটা বুঝতেই চাই না আমরা। বিশ্বে প্রথম দশটি সুখি দেশ- তারা ধনী নয়, কিন্তু সুখি। এই ১০টি দেশের তালিকায় কানাডার নাম আছে। গুগলে সার্চ দিলে সুখি ও ধনীদের পার্থক্যটা বুঝা যাবে। কানাডা বিশ্বের অষ্টম অর্থনৈতিক শক্তি। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান, সৌদিআরব, ভারত, আরব আমিরাত, কাতার এবং আরো অন্যান্য ধনী এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র কিন্তু তারা সুখি নয়। বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে। সুখি দেশ হওয়ার মানবিক দিকগুলো ধনী দেশগুলোতে অনুপস্থিত বলেই তারা অসুখি। (সমাপ্ত)
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক।
harunrashidar@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন