ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে প্রায় অর্ধলক্ষ বাংলাদেশি কর্মী দীর্ঘদিন ধরে বৈধতার সংকটে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত থাকলেও উপমহাদেশে মালদ্বীপই একমাত্র দেশ যেখানে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। প্রায় ১২শত দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপের মাত্র ২০০টি দ্বীপে জনবসতি রয়েছে, যার জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। মূলত পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশ মালদ্বীপে স্থানীয় জনসংখ্যার পর সম্ভবত বাংলাদেশিদের সংখ্যাই সর্বাধিক। বন্ধুপ্রতিম মুসলিম দেশ হিসেবে মালদ্বীপের পর্যটনশিল্প এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায় বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ সাদরে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে করোনাকালীন বাস্তবতায় সৃষ্ট কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার দিগন্ত বিস্তারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অর্ধলক্ষাধিক অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীর বৈধতা এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে উচ্চ পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত আছে। গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৬ দিনের মালদ্বীপ সফরে বাংলাদেশী কর্মীদের বৈধতা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদি হলেও সফরের ২ মাস পর বোঝা গেল, এখনো সমস্যা নিরসন হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরে এ নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো সুরাহা না হওয়া দু:খজনক।
মালদ্বীপ কোনো শিল্পোন্নত রাষ্ট্র নয়। মূলত: সামুদ্রিক পরিবেশে উন্নত হোটেল ও পর্যটনশিল্পের উপর ভর করে দেশটি তার অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। মালদ্বীপের হোটেল-মোটেল ও পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ খুব বেশি না হলেও পর্যটনসহ সেখানকার সেবাখাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশির অংশগ্রহণকে মালদ্বীপের সরকার ও জনগণ ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় সারাবিশ্বে পর্যটনখাতসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দা দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে মালদ্বীপের বাংলাদেশি কর্মীরাও কর্মসংস্থান হারানোসহ বেতন-ভাতায় হ্রাসের সম্মুখীন হয়। করোনার প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে অর্থনীতি ও পর্যটনখাত নতুন গতি ও সম্ভাবনা দেখা দিলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা সে সব সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করলেও তারা এখনো আগের অবস্থানে পৌছাতে পারেনি। প্রথমমত: বৈধ শ্রমিকরা এখনো স্বল্প বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, দ্বিতীয়ত: অর্ধলক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী বৈধতার চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে অথবা আউটপাস নিতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষনীয় পর্যটন রাষ্ট্র মালদ্বীপের অধিকাংশ দ্বীপ এখনো জনমানবশূন্য, ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনাময় বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিভিন্ন দ্বীপে নতুন নতুন হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানা যায়। সে ক্ষেত্রে সেখানে অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধতা দিয়ে কাজের সুযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের সউদী আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ট্রাডিশনাল শ্রমবাজারে লাখ লাখ কর্মী এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নানাবিধ সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রবাসী কর্মীরা সে সব দেশের হাইকমিশন, কনস্যুলেট এবং মিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা ও নিস্ক্রিয়তাসহ নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। ডিসেম্বরে ধারাক্রমে নিচ থেকে সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মালদ্বীপ সফরের পর ইতিবাচক , সৌর্হাদ্যপূর্ণ আলোচনা ও দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পরও অর্ধলক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকের বৈধতা নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে সেখানকার রাষ্ট্রদূত ও সংশ্লিষ্ট মিশন কর্মকর্তাদের অবহেলা ও নিস্ক্রীয়তা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি অথবা স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা করা হলেও চলতি মাসে প্রবাসি রেমিটেন্স প্রবাহ অর্ধেকে নেমে আসার হতাশাজনক বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় মালদ্বীপসহ মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধতা, আইনগত জটিলতা এবং দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ক’টনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মালদ্বীপ সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত অভিবাসন চুক্তিটি চুড়ান্ত হওয়ার আগেই এ বিষয়ে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন