শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইউক্রেনে রুশ হামলা : সংযম ও শান্তিই কাম্য

| প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:১০ এএম

এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার বিশাল সীমান্ত এবং সামাজিক-সংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। রাশিয়ার নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইউক্রেনে ন্যাটো ও মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এটাই হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান দ্বন্দ্বের মূল কারণ। বেশ কয়েক মাস ধরেই ইউক্রেনে রাশিয়ার সমরাভিযানের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। গত কয়েকদিনে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশ ও কৌশলগত সমরাস্ত্রের মজুদবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে যে কোনো সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হতে পারে, এমনটাই মনে করা হচ্ছিল। এই আশঙ্কার মধ্যেই পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ লুহানস্ক ও ডোনেস্ক অঞ্চলে রাশিয়ার অনুগত বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এর দুইদিনের মধ্যেই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা লুহানস্ক ও ডোনেটস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রিপাবলিক হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। এরই জবাবে অবশেষে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করেছে। গতকাল দুপুরে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রুশ বাহিনী ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্ত থেকে রাজধানী কিয়েভ পর্যন্ত ভারী মর্টার শেল নিক্ষেপ ও বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন এলাকার বাইরে পোডিলস্কি, মারিপোল, ডনবাস ও ওদেসা অঞ্চলে রুশ বিমান হামলার পাশাপাশি আর্টিলারি হামলা চলছে।

ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার এই উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংঘাতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা এবং তা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরেপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জ্বালানি নির্ভরতা রাশিয়ার পাইপলাইনের উপর। নর্ড স্ট্রিম-১ নামে পরিচিত পাইপলাইনের পর নির্মীয়মান দ্বিতীয় লাইন নর্ডস্ট্রিম-২-এর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানি। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণেও ইউরোপে রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। জ্বালানি খাতের যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত সারাবিশ্বের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। এমনিতেই করোনাকালীন বাস্তবতায় বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে। করোনাত্তর অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ও আয়বৈষম্য বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের জন্য নতুন সংকট হয়ে দেখা দিতে পারে। জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে একটি নতুন মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে। সেখানে ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। একটি অন্যায়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে বড় শক্তিগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার বড় স্বার্থও অগ্রাহ্য হতে দেখা যায়। চলমান পরিস্থিতির ওপর আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী করা যায়, সেটা ভেবে-চিন্তে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাশিয়াসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে সব পক্ষকেই সংযত আচরণ করতে হবে। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়া নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীল অংশীদার। অন্যদিকে গণতন্ত্র, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মজুদ ইত্যাদি নানা প্রশ্নে সাম্প্রতিক দশকে ইরাক-আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ন্যাটো জোটসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পশ্চিমা এই জোট মানুষের আস্থা অনেকটাই হারিয়েছে। এ কারণেই ন্যাটো জোটের হুমকি ইউক্রেনের বিদ্রোহী বা রাশিয়ার সামরিক হামলার বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। ন্যাটো ও পশ্চিমাদের উস্কানিমূলক তৎপরতার অভিযোগ সামনে রেখে ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় রাশিয়া। এবার প্রথম দফায় লুহানস্ক ও ডোনেটস্কের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়ার পর এখন ক্রিমিয়ার রাজধানী পর্যন্ত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে রুশ বাহিনী। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এন্তোনিও গুতেরেস রাশিয়ান বাহিনী সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়ান সামরিক হামলায় শত শত মানুষ হতাহতের খবর দিয়েছে ইউক্রেনের গণমাধ্যম। প্রতিটা জীবন মূল্যবান, প্রতিটা জনপদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি ও ঐকমত্য রয়েছে। তাই রাশিয়া, ইউক্রেনসহ আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতি সব পক্ষকে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন