সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীর গুলিস্তান পার্কে মহানগর নাট্যমঞ্চের পাশে অস্থায়ী ভিত্তিতে হকারদের পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এ নিয়ে নাগরিকদের পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন, ইতিহাসবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, সামাজিক সংগঠক ও পরিবেশবাদীরা। তার বলছেন, এখানে হকার পুনর্বাসন করা হলে এ পার্কটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। পার্কটি রক্ষা করতে প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার হুশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। পরিবেশবাদীদের সাথে কথা বলে এসব পদক্ষেপের কথা জানা যায়।
তবে এই পার্কে অস্থায়ী পুনর্বাসনের সুযোগ নিতে বহু হকারই আগ্রহী নন বলে জানা গেছে। তাদের আশঙ্কা, এখানে কোনো ক্রেতা যাবে না। আর স্থানীয় রাজনীতিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন।
পার্কটি রক্ষার নিমিত্তে নগরবাসীর পক্ষ থেকে বিশিষ্টজন, ইতিহাসবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, সামাজিক সংগঠক ও পরিবেশবাদীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সাথে সাক্ষাৎ করে পার্ক ও হকার বিষয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র জানান, তিনি পুরো পার্ক নয়, মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে বা আশপাশের খালি জায়গায় হকারদের বসার ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। এ সময় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে মহানগর নাট্যমঞ্চটি পার্কের অংশ বলে সেখানে হকারদের না বসানোর আহŸান জানান। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার জন্য মেয়র একটি গোলটেবিল বৈঠকে সবার কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন ওই প্রতিনিধিদলকে।
সম্প্রতি নগরীর গুলিস্তানের ফুটপাত দখল করতে গিয়ে হকারদের সাথে সংঘর্ষ বাধে সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও কর্মকর্তাদের সাথে। এ সময় দলবল নিয়ে হকাররা নগরভবনে চলে যান। নগরভবনের মূল গেটের সামনে নগরভবনের আনসার ও পুলিশ তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা করে। বাধা উপেক্ষা করে হকারদের একটি অংশ নগরভবনের ভেতরে ঢুকে হৈ চৈ করে। পরে কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মহানগর ছাত্রলীগের একটি দল হকারদের ধাওয়া ও মারধর করে তাড়িয়ে দেন। এ সময় ছাত্রলীগের দুই নেতা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন মেয়র সাঈদ খোকন। পরে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতির একদিন পর নগরভবনে হকার পুনর্বাসন বিষয়ে কাউন্সিলরদের সাথে মতবিনিময় করেন সাঈদ খোকন। এ সময় তারা গুলিস্তান পার্কের ভেতর মহানগর নাট্যমঞ্চ, কাজী বশির মিলনায়তনের আশপাশের খালি জায়গায় দুই হাজার ৫০৬ জন হকারকে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান।
পরে মেয়র গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, মহানগর নাট্যমঞ্চটি খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে না। এ থেকে রাজস্বও তেমন একটা আসে না। আমরা এর আশপাশে গুলিস্তানের হকারদের অস্থায়ীভিত্তিতে পুনর্বাসন করতে একমত হয়েছি। পরবর্তীতে কোনো মার্কেট কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন করা হবে।
মেয়রের এমন সিদ্ধান্তকে নগরবাসীর পাশাপাশি মেনে নিতে পারছেন না পরিবেশবাদীরাও। তারা বলছেন, এটা কোনোভাবেই আইনসঙ্গত নয়। কর্পোরেশন যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যে কেউ আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। তাই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাঠে নামছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের এসব প্রতিবাদের পর ডিএসসিসি এই উদ্যোগ থেকে সরে না দাঁড়ালে আইনি প্রক্রিয়ায় যাবেন পরিবেশবাদীরা, এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
গতকাল শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় ৩.৫০ একর আয়তনের এই পার্কের চারপাশে দেয়ালঘেরা। ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ, মাঠে সবুজ ঘাস। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে কাজী বশির মিলনায়তন (মহানগর নাট্যমঞ্চ)। ভেতরে চারপাশে রয়েছে বেঞ্চ। এতে শুয়ে-বসে আছে ভাসমান মানুষ। পার্কের মাঝে পুকুরের পানিতে ভাসছে ময়লা-আবর্জনা। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে গোসল করছে। পার্কের মাঝে আরেকটি কৃত্রিম পুকুরও আবর্জনায় ভরা। মিলনায়তনের পশ্চিম পাশে দেয়াল ঘেঁষে আবর্জনার স্তুপ রয়েছে। এই অংশেই হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, স্বাধীনতার আগে গুলিস্তানের ওই এলাকা পল্টন মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে গভর্নর হাউস (বঙ্গভবন) ও পল্টন স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় পার্কটি সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত মতিউরের নামে এই পার্কটি শহীদ মতিউর শিশুপার্ক হিসেবে নামকরণ করা হয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকে পার্কের পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে। এই পার্কে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসন করা হলে পার্কের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। ডিএসসিসিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা দরকার।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, মহানগরের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও জলাধার আইন অনুযায়ী, গুলিস্তান পার্কে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। এই পদ্ধতিতে হকারদের সমস্যার সমাধান করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এভাবে ঢাকা শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ পার্ক বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, গুলিস্তানের হকার উচ্ছেদ একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা রাজনৈতিক ও পরিকল্পিতভাবেই সমাধান করতে হবে। এর আগেও হকারদের চাহিদা মেটাতে গুলিস্তানে অপরিকল্পিতভাবে অনেক মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে পার্কটি সংস্কার করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, এমনিতেই ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম বসবাস অনুপযোগী শহর। ঢাকার দুই মেয়র নির্বাচনের আগে এই শহরকে সবুজায়ন করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তারা হকারদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য উন্নয়নের নামে ঢাকার মাঠ-পার্ক দখল করে সবুজায়নকে ধ্বংস করছেন।
তিনি বলেন, গুলিস্তানের এই পার্কে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসন করা হলে পার্কের অস্তিত্ব বলে কিছুই থাকবে না। অথচ দেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের অন্যতম অংশ জড়িয়ে আছে এই পার্ক। সিটি কর্পোরেশনকে এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
বাপার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী গুলিস্তান পার্কে হকারদের পুনর্বাসন করা যাবে না।
বাপার যুগ্ম-সম্পাদক ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সদস্য শরীফ জামিল বলেন, ২০০৪ সালে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছেÑ কোনো খেলার মাঠ কিংবা পার্ক অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন যদি এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকে, তাহলে তারা আদালত অবমাননা করবে। তাদের এ উদ্যোগ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক।
জানা গেছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ বা পার্ক থাকার কথা। আর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নীতিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকার প্রতিটি সেক্টরে একটি খেলার মাঠ বা পার্ক রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। উপরন্তু যে কয়টি রয়েছে, সেগুলোও উদ্ধার কিংবা চলাচল উপযোগী করতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, সিটি জরিপে মহানগর নাট্যমঞ্চ ও গুলিস্তান পার্ক আলাদা উল্লেখ রয়েছে। ডিএসসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাট্যমঞ্চের আশপাশেই অস্থায়ীভাবে হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হবে, পার্কে নয়। এতে গুলিস্তানের সড়কে রোগীর গাড়ি চলাচল, শিশুদের স্কুলে যাতায়াতসহ পথচারীদের চলাচলে বাধার সৃষ্টি হবে না। তিনি বলেন, গুলিস্তানের দুই হাজার ৫০৬ জন হকারের একটি তালিকা তৈরি করেছে ডিএসসিসি। শিগগিরই গুলিস্তানে আবার বড় আকারের উচ্ছেদ চালানো হবে। ফুটপাত ও সড়কের এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও আর দখল হতে দেয়া হবে না।
হকারদের হাত থেকে গুলিস্তান পার্কটি রক্ষা করতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বেশ কয়েকটি পরিবেশ সংগঠন। গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংগঠনগুলো এ নিয়ে মানববন্ধন করেছে। সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম, প্রত্যাশা মাদকবিরোধী সংগঠন, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন কমিটি, গ্রিন ভয়েস, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিং এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন