মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কারাগারের কনডেম সেলের নির্জন প্রকোষ্ঠে একাকিত্ব জীবন কাটছে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের। স্ত্রী-সন্তানের জন্য অপকর্ম করে গড়েছিলেন সম্পদের পাহাড়। ক্ষমতার জোরে সৎবোন রত্না বালা প্রজাপতির বাড়ি পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এখন পাশেও পাচ্ছেন না স্ত্রী চুমকিকে। প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের নামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাসহ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাতে। প্রদীপপত্নী দেশেই কোথাও লুকিয়ে আছেন না পালিয়ে বিদেশে গেছেন তা বলতে নারাজ স্বজনরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও চুমকির অবস্থানের সঠিক কোনো তথ্য স্পষ্ট করতে পারছে না।
এদিকে চুমকি যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদরদফতরে চিঠি দিয়েছে দুদক। তবে এর আগেই তিনি দেশ ছেড়েছেনÑ এমনই ধারণা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর। তারা বলছেন, অনেক অনুসন্ধানের পর মনে হচ্ছে, প্রদীপের স্ত্রী চুমকি সন্তানসহ ভারতে পালিয়ে গেছেন। কারণ তাকে দেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশ সদর দফতর ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, প্রদীপ কুমার গ্রেফতারের পর চুমকি কারণ প্রথমে চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাটে এক স্বজনের বাসায় কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর থেকে তার আর হদিস মিলছে না। প্রাথমিক তথ্য রয়েছে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধপথে ভারতে পালিয়েছেন। তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, কথিত আছে, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের আগরতলা, বারাসাত, গৌহাটিতে এই দম্পত্তির নামে একাধিক বাড়ি রয়েছে। বিদেশে পাচার করেছেন অঢেল টাকা। রয়েছে ভারতীয় পাসপোর্ট। মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রদীপকে চট্টগ্রাম থেকে কড়া নিরাপত্তায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। তিনি দেড় বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন।
সূত্র মতে, গত ৩১ জানুয়ারি সিনহা হত্যায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি (বর্তমানে বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। মামলায় ছয় জনকে যাবজ্জীবন ও সাত জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত ৯টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা। এর পর ৬ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় প্রদীপকে।
ঘুষ-দুর্নীতিতে উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর নামে: সিনহা হত্যা মামলা ছাড়াও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলার আসামি প্রদীপ কুমার দাশ। জানা গেছে, তার সব সম্পত্তিই স্ত্রী চুমকি কারনের নামে। চুমকি গৃহিণী। তার বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞাত আয়ের উৎস নেই। ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় প্রদীপের সঙ্গে তার স্ত্রী চুমকিকেও আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনেন তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর নামে হস্তান্তর ও স্থানান্তর করেছেন।
দুদকের এজাহারে বলা হয়, প্রদীপের বাবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) একজন নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। ১৯৯৫ সালে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে যোগ দেন প্রদীপ। ২০০২ সাল থেকে তার সম্পদের পাহাড় প্রকাশ হতে থাকে। নানা কারণে তিনি আলোচিত হতে থাকেন। প্রদীপ ও তার স্ত্রীর নামে থাকা চট্টগ্রামের পাথরঘাটা ও মুরাদপুরে সৎবোন রত্না বালা প্রজাপতির কাছ থেকে কেড়ে নেয়া চারতলা বাড়িসহ সব সম্পত্তি আদালতের নির্দেশে ক্রোক করেছে পুলিশ। ওসি থাকাকালে প্রদীপ ক্ষমতার জোরে বাড়িটি দখল করেন। রত্না বালা প্রজাপতি সাংবাদিকদের বলেন, দুদকের মামলার পর হদিস মিলছে না চুমকি ও তাদের সন্তানের। অথচ এর আগে তিনি প্রদীপের অবৈধ উপার্জনের অর্থে নগরীর পাথরঘাটায় গড়ে তোলা লক্ষ্মীকুঞ্জ ভবনে থাকতেন।
চুমকি কারন কোথায় আছেনÑ সেটা জানতে চাইলে তার বাবা অজিত কুমার কারন সাংবাদিকদের বলেন, মেয়ে কোথায় আছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে নারাজ। চুমকি কারনের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর সম্পর্কেও কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।
দুদকের দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রামের পাথরঘাটার ছয়তলা বাড়ি, ষোল শহরের বাড়ি, ৪৫ ভরি সোনা, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, একটি মাইক্রোবাস, ব্যাংক হিসাব এবং কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে চুমকির নামে। তার ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। এছাড়া চুমকি নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী দাবি করলেও এ ব্যবসায়ের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অভিযোগপত্রে সাক্ষী রাখা হয়েছে ২৯ জনকে। দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, পলাতক আসামির বিরুদ্ধে আদালত নতুন করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আর ক্রোক করা সম্পত্তি জেলা প্রশাসকের জিম্মায় রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন