বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

প্রদীপের ২০ চুমকির ২১ বছর কারাদণ্ড

দুর্নীতির মামলা ৪ কোটি টাকা জরিমানা সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

দুর্নীতির দায়ে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ বছর এবং তার স্ত্রী চুমকি কারনকে ২১ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই রায়ে আদালত তাদের চার কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন। রায়ে আদালত তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তেরও নির্দেশ দেন। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদ প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের আলোচিত মামলার এ রায় ঘোষণা করেন। তার আগে কড়া নিরাপত্তায় প্রদীপ ও তার স্ত্রীকে আদালতে হাজির করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক জানান, আদালত আসামিদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন। প্রদীপ কুমার দাশ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে সেই সম্পদ স্ত্রীর অনুকূলে স্থানান্তর করে মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ সংঘটিত করেছেন। প্রদীপ তিনটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তার স্ত্রী চুমকি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন চারটি ধারায়।

আদালত রায়ে মানিলন্ডারিং আইনের ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, চার কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় উভয় আসামিকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় উভয় আসামিকে আট বছর করে কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই আইনের ২৬ (১) ধারায় চুমকিকে এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে ২৬ (১) ধারায় আসামি প্রদীপ কুমার দাশ খালাস পেয়েছেন।

আদালত বিভিন্ন ধারায় দেয়া সাজা একইসঙ্গে কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে অবৈধভাবে যে সম্পদের মালিক দু’জন হয়েছেন, তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছে আদালত। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও দুদককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায় দুর্নীতির বিচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করি।

এদিকে আদালত কক্ষে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রদীপ চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমি দুর্নীতি করিনি। আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি নিজের স্বার্থে কিছুই করিনি, যা করেছি রাষ্ট্রের স্বার্থে। রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেয়ার সময় চুমকি কারন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। আমার স্বামী ভালো কাজ করেছেন বিধায় বিভিন্ন মহল তার বিরুদ্ধে লেগেছিল। তারা ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করেছে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলায় প্রদীপসহ দু’জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ ও চুমকি কারনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়। দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকা প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদক অভিযোগ করে। আরও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করার অভিযোগও আনা হয়।

তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ২৬ জুলাই দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আদালতে দু’জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৫ ডিসেম্বর দুদকের মামলায় আসামি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। অবৈধ সম্পদের মামলা দায়েরের পর থেকে চুমকি কারন আত্মগোপনে ছিলেন। সাক্ষ্য চলাকালে গত ২৩ মে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে কারাগারে আছেন। গত ২৯ মে এ মামলায় মোট ২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ৬ জুন থেকে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ১৮ জুলাই যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন।
ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে বিপুল সম্পদের মালিক হন প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারন। নগরীর পাথরঘাটায় কয়েক কোটি টাকার ছয়তলা বিলাসবহুল ভবন, একাধিক গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমির মালিক তারা। দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, অবৈধ এসব সম্পদ নিজের কাছে রাখতে স্ত্রী চুমকি কারনের নামে নেন প্রদীপ। গৃহিণী হয়েও তার স্ত্রী চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে ভুয়া মৎস্য চাষ দেখান। এমনকি নিজের ঘুষের টাকায় তৈরী ছয়তলা বাড়িটি শ্বশুরের দান করা দাবি করেন প্রদীপ। দুদকের তদন্তে উঠে আসে পাথরঘাটায় ‘লক্ষ্মীকুঞ্জ’ নামের ছয়তলা একটি বিলাসবহুল বাড়িটি সবাই চেনে ওসি প্রদীপের বাড়ি হিসাবে। এই আলিশান বাড়িটি ওসি প্রদীপ নিজের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেছেন। নগরীর পাঁচলাইশে জোর করে দখল করা একটি বাড়িও আছে তার। আছে কয়েকটি গাড়ি। কক্সবাজারে আছে জমি, ফ্ল্যাট। মামলার অভিযোগপত্রে প্রদীপের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জন করে সেই সম্পদ স্ত্রীর নামে হস্তান্তরের অভিযোগের তথ্যপ্রমান উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া উভয়ের বিরুদ্ধে ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৭ টাকার অর্জিত সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখের তথ্যপ্রমাণ পায় দুদক। অভিযোগপত্রে চুমকি কারণের নামে পাথরঘাটায় দুই কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৭০০ টাকা দামের ছয়তলা বাড়ি, পাঁচলাইশ থানার পশ্চিম ষোলশহর এলাকায় এক কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা দামের জমি এবং কক্সবাজারের ঝিলংঝা মৌজায় ১২ লাখ পাঁচ হাজার ১৭৫ টাকার একটি ফ্ল্যাটের বিষয় উল্লেখ আছে। সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারন নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করে সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছিলেন। তবে অভিযোগপত্রে মাছের ব্যবসা থেকে চুমকির আয়ের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Sohel Akbar ২৮ জুলাই, ২০২২, ৭:৫৭ এএম says : 0
একজন মানুষকে এইভাবে হত্যা করার পর বিচার হলো ২১ বছর জেল।কি সুন্দর বিচার দেশের
Total Reply(0)
ইবনে মালীক ২৮ জুলাই, ২০২২, ৭:৫৮ এএম says : 0
প্রদিপের ফাঁসি কার্যকর কবে হবে সেই অপেক্ষায় সাধারণ জনগণ।
Total Reply(0)
Arifin Mehedi ২৮ জুলাই, ২০২২, ৭:৫৮ এএম says : 0
OC prodep ar 20yrs keno Tar Fasi hoya uchit
Total Reply(0)
Munna ২৮ জুলাই, ২০২২, ৮:৩২ এএম says : 0
তাকে হত্যা করার পরও কীভাবে এখোনো জিবিত আছে, আর তাকে যে ধরনের কারধন্ড দেয়া হচ্ছে যেন তার জন্য এটা জেলনা বালা খানা
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন