শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বীমায় সুরক্ষিত থাকলে এগিয়ে যাব সবাই মিলে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২২, ১২:০৬ এএম

১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবস। বীমা শিল্পের উন্নয়ন ও বীমা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার এটি প্রবর্তন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেন। তার এ যোগদানের দিনটিকে জাতীয় পর্যায়ে স্মরণীয় রাখতে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুপারিশক্রমে প্রতিবছর ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। ওই বছরের ১ মাস এটি প্রথম দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবছর জাতীয় বিমা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বীমায় সুরক্ষিত থাকলে এগিয়ে যাব সবাই মিলে’।

বীমা হচ্ছে একজনের ঝুঁকিকে অনেকের কাঁধে বিস্তৃত করার একটি বৈধ ব্যবস্থা। এটা এমন এক ধরনের চুক্তি যেখানে কোন বীমা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত হারে প্রিমিয়াম গ্রহণের বিনিময়ে কয়েকটি অদৃষ্টপূর্ব কারণে বীমাকৃত দ্রব্যের ক্ষতি হলে তা বীমাকারী ব্যক্তিকে পূরণ করে দিতে সম্মত থাকে। বীমা কোম্পানিগুলোকে প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে মুক্ত থাকে এবং অসংখ্য বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে বীমা কোম্পানিগুলো মূলধন বৃদ্ধি করে। বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াও ব্যাক্তিগতভাবে অর্থ সঞ্চয় করে সম্ভাব্য ঝুঁকির দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায়। বীমা প্রক্রিয়া, ক্ষয়ক্ষতির ধরন এবং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি মেনে চলতে হয়।

বাংলাদেশে বীমা ব্যবস্থার একটি ইতিহাস আছে। প্রায় ১০০ বছরেরও আগে ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে কয়েকটি বীমা কোম্পানি জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা উভয় ধরনের ব্যবসা শুরু করেছিল। ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে বীমা ব্যবসা ভাল অবস্থায় ছিল। এ সময় ৪৯টি জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করত। এসব কোম্পানির উৎস ছড়ানো ছিল বিভিন্ন দেশে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান অন্যতম। ১০টি বীমা কোম্পানির সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে, ২৭টির পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাকিগুলির সদর দপ্তর ছিল বিশ্বের নানাদেশে। কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ কোম্পানিই ছিল সীমিত দায়ের এবং কাজ করত অবাধ প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক পরিবেশে।

এগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বিশেষায়িত কোম্পানি, যারা নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। আবার কিছু ছিল যৌথ কোম্পানি, যেগুলি একাধিক ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৯৫ দ্বারা বীমা শিল্পকে জাতীয়করণ করে। এই আদেশ বাংলাদেশ বীমা (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২ হিসেবে বেশি পরিচিত। এই আদেশবলে প্রতিরক্ষা, ডাক জীবন বীমা এবং বিদেশি জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ ব্যতীত এদেশে ব্যবসারত সকল বীমা কোম্পানি ও সংস্থাকে সরকারি খাতের ৫টি কর্পোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এগুলি হচ্ছে জাতীয় বীমা কর্পোরেশন, তিস্তা বীমা কর্পোরেশন, কর্ণফুলি বীমা কর্পোরেশন, রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং সুরমা জীবন বীমা কর্পোরেশন।

জাতীয় বীমা কর্পোরেশন সরাসরি বীমা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। একটি শীর্ষ সংস্থা হিসেবে এটি বীমা কাজে নিয়োজিত অন্যান্য ৪টি কর্পোরেশনের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করত। তিস্তা ও কর্ণফুলি সাধারণ বীমা ব্যবসা করত, রূপসা ও সুরমা জীবন বীমার কাজ করত। সে সময়ে চালুকৃত ৪৯টি বীমা কোম্পানিকে এই ৪টি কর্পোরেশনের সাথে একীভূত করা হয়। পক্ষান্তরে বিশেষায়িত জীবন বীমা কোম্পানি বা মিশ্র কোম্পানির জীবনবীমা অংশটুকু রূপসা ও সুরমার সাথে এবং বিশেষায়িত সাধারণ বীমা কোম্পানি বা মিশ্র কোম্পানির সাধারণ বীমা অংশটুকু তিস্তা ও কর্ণফুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।

জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানির প্রতিটিতে ২টি করে মোট ৪টি বীমাকারী কর্পোরেশন গঠনের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়করণকৃত ব্যবস্থার অধীনেও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩-এর আওতায় বীমা শিল্পে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়। এই আইনের আওতায় ৫টি কর্পোরেশনের স্থলে ২টি কর্পোরেশন স্থাপন করা হয়। একটি হচ্ছে সাধারণ বীমা ব্যবসায়ের জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং অন্যটি জীবন বীমা ব্যবসায়ের জন্য জীবন বীমা কর্পোরেশন।

পরিবর্তীকালে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতির ফলে বীমা শিল্পে অবকাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৮৪ সালে বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩ এর সংশোধনী আনা হয়। এতে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা কর্পোরেশনের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানা খাতে বীমা কোম্পানি পরিচালনার ব্যবস্থা রাখা হয়। বীমা কর্পোরেশন (সংশোধনী) আইন ১৯৮৪, ব্যবসা পরিচালনা এবং পুনঃবীমা সংক্রান্ত কয়েকটি বিধিনিষেধ সাপেক্ষে ব্যক্তিমালিকানা খাতে সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানি স্থাপনের অনুমতি দেয়। নতুন আইনের আওতায় সরকারি আর্থিক খাতের সাধারণ বীমার সকল ব্যবসা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে ব্যক্তিমালিকানা খাতের বীমা কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বেসরকারি আর্থিক খাতের বীমা ব্যবসা করারও অধিকার দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে কিছু প্রতিরক্ষা প্রদান এবং একইসাথে বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলিকে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রদানের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানি কর্তৃক পুনঃবীমা ব্যবস্থা সংক্রান্ত আরও একটি বিধিনিষেধ ছিল। আইনে বলা হয়, বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিসমূহকে তাদের পুনঃবীমা প্রতিরক্ষার ১০০ শতাংশ অবশ্যই সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে নিতে হবে এবং তারা পুনঃবীমার জন্য অন্য কোথাও যেতে পারবে না। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হচ্ছে পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের আকারে যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে যেতে না পারে এবং যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য অনুযায়ী একটি পুনঃবীমা বাজার গড়ে ওঠে তার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

এই ব্যবস্থা বস্তুতপক্ষে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে একটি পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। অবশ্য পাশাপাশি তাদের সরাসরি বীমা কার্যক্রমও চলতে থাকে। তবে সর্বমোট বাজার ধারণক্ষমতা সংরক্ষণের পর সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে পুনঃবীমাকরণে অনুমতি দেওয়া হয়। বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলি সীমাবদ্ধতাসমূহ পুরোপুরি তুলে নেয়ার দাবি উত্থাপন করে যাতে তারা সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যক্তি ও সরকারি উভয় খাতের বীমা ব্যবসা করতে পারে এবং তাদের পছন্দমতো পুনঃবীমাকারীর নিকট পুনঃবীমা করতে পারে।

এর ফলে বীমা কর্পোরেশন (সংশোধনী) আইন ১৯৯০ জারির মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তনগুলি হচ্ছে: ১. বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলি ব্যক্তি খাত থেকে উৎসারিত বীমা ব্যবসায়ের ৫০ শতাংশ করতে পারবে। ২. ব্যক্তি খাতের বীমা কোম্পানিগুলি তাদের পুনঃবীমার ৫০ শতাংশ দেশে অথবা বিদেশের যে কোনো পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট করতে পারবে। বাকি ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অধীনে রাখা হয়।

দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ শস্য বীমা ও রপ্তানি ঋণ গ্যারান্টি ছাড়া প্রায় সকল ধরনের সাধারণ ও জীবন বীমার কাজ করে থাকে। এই ২টি বিশেষ বীমা শুধু সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, সমিতি, পেশাভিত্তিক গ্রুপ বীমা ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য কাজ করে থাকে। এগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল: ১। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন: ১৯৮৮ সালের ২৫ মে ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় এটি গঠিত হয় এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি রেজিস্ট্রারের নিকট নিবন্ধিত হয়। এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬০ এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সদস্য কোম্পানিগুলির উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, সহযোগিতা প্রদান এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। ২। বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স একাডেমি: বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে এটি বীমা বিষয়ে পেশাগত শিক্ষার উন্নয়ন, আয়োজন ও শিক্ষা প্রদান এবং বীমা বিষয়ে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে স্থাপন করে। ৩। জরিপকারী ও দালাল: বাংলাদেশের বীমা ব্যবসায় জরিপকারী এবং দালালগণ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। জরিপকারীরা সাধারণ বীমার ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও জরিপের দায়িত্ব এবং কখনও কখনও বীমাকৃত সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। পক্ষান্তরে দালালগণ কমিশনের বিনিময়ে সাধারণ ও জীবন বীমা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। বীমা কোম্পানিগুলি বেতনভুক্ত উন্নয়ন কর্মকর্তাও নিয়োগ করে থাকে।

বেসরকারি কোম্পানি কর্তৃক বীমা করানোর জন্য সাতটি বীমাযোগ্যতার মূলনীতি মেনে চলতে হয়: ১। একই ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে এমন অনেক উপাদানের অস্তিত্ব প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান থাকতে হবে, ২। বীমা কোম্পানি শুধুমাত্র একটি বা একাধিক নির্দিষ্ট ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকবে, ৩। দুর্ঘটনাজনিত পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রনের বাইরে থাকবে, ৪। বৃহৎ আকারের ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই বীমাকৃত ব্যাক্তির সাপেক্ষে যুক্তিযুক্ত হতে হবে, ৫। প্রিমিয়াম অবশ্যই সাশ্রয়ী হতে হবে, ৬। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই পরিমাণযোগ্য হতে হবে এবং ৭। প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সীমিত হবে।
লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন