বাংলাদেশের শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ, জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম. আর খান (মোহাম্মদ রফি খান) আর নেই। মানবসেবায় জীবন উৎসর্গকারী জাতির এই কৃতী সন্তান গত শনিবার বিকালে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি কোমরে ব্যথা, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তার মৃত্যু পরিণত বয়সের হলেও দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা অপূরণীয়। ‘এম আর খান’ এদেশে কিংবদন্তিতুল্য নাম। তিনি কেবলমাত্র একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। একজন সাধারণ চিকিৎসক থেকে কিভাবে তিনি দেশের শিশু চিকিৎসার পথিকৃতে পরিণত হয়েছিলেন, সে এক লম্বা ইতিহাস। এদেশে প্রায় এমন কোনো খ্যাতিমান শিশু চিকিৎসক নেই যার তিনি শিক্ষক ছিলেন না। এখন যারা শিশু চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন, অনেকেই তার ছাত্র কিংবা ছাত্রের ছাত্র। তাদের কাছে তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় ও অভিভাবকতুল্য। তিনি তার অধ্যাপনা ও চিকিৎসা পেশার শুরুতেই শিশু চিকিৎসার দিকটি বেছে নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন না বলেই চলে। বাংলাদেশ এখন শিশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে, শিশু চিকিৎসার জন্য যে নির্ভরযোগ্য অবস্থা এখানে তৈরি হয়েছে এবং শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে যে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার পেছনে এম আর খানের অবদান অনস্বীকার্য ও অবিস্মরণীয়। তিনি এবং তার ছাত্র ও ছাত্রের ছাত্ররা মিলে এক বিশাল জগৎ নির্মাণ করেছেন। তার মৃত্যুতে তাই সব মহলেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমরাও তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাভিভূত।
এম আর খানের জন্ম ১৯২৮ সালে সাতক্ষীরার রসূলপুরে বিখ্যাত খান পরিবারে। ১৯৫৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। এরপর এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিটিএমঅ্যান্ডএইচ, এমআরসিপি, লন্ডন বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ডিসিএইচ, ঢাকার পিজি থেকে এফসিপিএস এবং ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিপি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বিদেশ থাকাকালে তিনি ইংল্যান্ডের ম্যানটেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিষ্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন পদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন (শিশুস্বাস্থ্য) পদে তার পদায়ন হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসেন এবং শিশু বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি আইপিজিএমআর-এ অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইন্সটিটিউটের যুগ্ম পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ও পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে দীর্ঘ চাকরি জীবন থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও তার শিশু চিকিৎসা ও মানবসেবা আমৃত্যু অব্যাহত থাকে। পেনশনের টাকা দিয়ে তিনি ডা. এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট গড়ে তোলেন, যা দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা ও তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তার উদ্যোগে এ পর্যন্ত বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো: শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, শিশু স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতাল, সাতক্ষীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, রসূলপুর উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট ও নিবেদিতা নার্সিং হোম। পোলিও নির্মূল ও ধূমপান বিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
এক জীবনে একজন মানুষ কী করতে পারে, এম আর খানের জীবন দর্পণে দৃষ্টি দিলে তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং অবশ্যই বিস্মিত হতে হয়। চিকিৎসা মহৎ মানবসেবামূলক একটি পেশা। তিনি তার সারা জীবনকে এই পেশায় আটকে রেখে মানবসেবাকেই ব্রত করে নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি তার বিলক্ষণ পক্ষপাতিত্ব ছিল। শিশুরা খুবই নাজুক অবস্থায় থাকে। তাদেরই রোগ-ব্যাধি বেশি হয়। তাদের চিকিৎসা ও সেবা সবচেয়ে জরুরি। তিনি এই জরুরি কাজটি করার দায়িত্বই স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সফল। এখানেই তার জীবনের সার্থকতা। যারা চিকিৎসাসেবা ও মানবসেবায় নিজেদের সংযুক্ত করতে চান, তাদের জন্য এম আর খানের জীবন অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল হতে পারে। পরিশেষে আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন